হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ যাতে সাংগঠনিকভাবে দাঁড়াতে না পারে সে জন্য কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। সংগঠনটিকে সরকার আর কোনো কর্মসূচিতেও যেতে দেবে না।
দীর্ঘমেয়াদি চাপের মধ্যে ফেলে হেফাজতের সাংগঠনিক কাঠামোকে ভেঙে দেওয়ার কৌশল নেওয়া হয়েছে।
সরকার ও আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, বিভিন্নভাবে হেফাজতের নেতারা সরকারের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করলেও সংগঠনটিকে আর আস্থায় নিতে পারছে না সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। গত মার্চে দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজত সাম্প্রদায়িক জঙ্গি সংগঠনের মতো প্রকাশ্যে যে ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালিয়েছে তারপর সংগঠনটিকে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া যায় না বলে তারা মনে করছেন।
এর আগে ২০১৩ সালের ৫ মে সরকার পতনের টার্গেট নিয়ে ঢাকার শাপলা চত্বরে অবস্থান ও যে ধ্বংসাত্মক তাণ্ডব চালিয়েছিলো তারপরও হেফাজতকে ছাড়া দেয় সরকার। ওই সময় হেফাজতের নেতাদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এ কারণে হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সমঝোতা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। সরকার ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিকসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলো হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সমঝোতার অভিযোগ তোলে। ঢাকায় ৫ মের ঘটনার পর হেফাজতের শীর্ষ নেতা আহমদ শফীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক হয় এবং কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি দেয় সরকার।
আওয়ামী লীগ সূত্র আরও জানায়, তখন সরকারের ওই ছাড়কে দুর্বলতা হিসেবেই নিয়েছিল হেফাজতে ইসলাম। যার ফলে সংগঠনটি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দাবি নিয়ে অগ্রসর হয়, যা দেশের সংস্কৃতি, সংবিধান, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিরোধী। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছর আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে এবং সাম্প্রদায়িক তৎপরতাসহ সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। ঢাকার ধোলাইপাড়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান, বিভিন্ন ধরনের হুমকি, কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনা ঘটায়। সুনামগঞ্জের শাল্লায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা, এরপর আরও অগ্রসর হয়ে গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস থেকে পর পর তিন দিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় হেফাজত। সংগঠনটিকে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তির সুযোগ দেবে না সরকার। আগামীতে সংগঠনটিকে কোনো ধরনের সভা-সমাবেশ করতেও দেওয়া হবে না।
এদিকে হেফাজতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সব ধরনের উপাদান রয়েছে সরকারের হাতে। হেফাজত যে তাণ্ডব চালিয়েছে এবং যারা এর নেতৃত্ব ও নির্দেশনা দিয়েছেন সরকারের কাছে তার তথ্য প্রমাণ রয়েছে। গত ২৬, ২৭ ও ২৮ মার্চের সহিংসতার ঘটনায় ৭৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় হেফাজতের ৪৯ হাজারের বেশি নেতাকর্মী আসামি হয়েছেন বলে জানা গেছে। গত দুই মাসে সংগঠনটির শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দসহ অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং অনেকেই নজরদারিতে আছেন।
হেফাজতের নেতাদের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গত ৯ জুন হেফাজতের ৪৬ জনের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এর আগে গত এপ্রিলে হেফাজতের আমির জুনায়েদ বাবুনগরীসহ সংগঠনটির শীর্ষ পর্যায়ের ৫৪ নেতার ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়েছিল সন্ত্রাসে অর্থায়ন ও অর্থ পাচার প্রতিরোধে কাজ করা সংস্থা বিএফআইইউ।
সরকার সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, হেফাজতের নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আইনগত ভিত্তি সরকারের রয়েছে। তারা যে সব ঘটনা ঘটিয়েছে তার যথেষ্ট সচিত্র তথ্য, প্রমাণাদি সরকারের হাতে রয়েছে। হেফাজতের নেতাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আরও তথ্য, প্রমাণ সংগ্রহে তৎপর রয়েছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। হেফাজতের এ যাবতকালের সব অপতৎপরতার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা অভ্যাহত থাকবে বলেও সূত্রগুলো জানায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা বাংলানিউজকে বলেন, যেহেতু সরকারের হাতে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার যথেষ্ট উপাদান আছে তাই আইনগতভাবেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া অব্যাহত থাকবে। হেফাজত যে ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে সেটা সরকারের বিরুদ্ধে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। তাদের সাংগঠনিকভাবে আর মাথা উচু করে দাঁড়াতে দেওয়া হবে না।