করোনাভাইরাসের কারণে গেল বছর এসএসসি পরীক্ষা নেওয়া গেলেও এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থীরা সাত মাস এবং এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা পাঁচ মাস ধরে দিন গুনছে পরীক্ষার টেবিলে বসার জন্য।
সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী করোনা পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে ছোট পরিসরে আগামী নভেম্বরের মাঝামাঝি এসএসসি এবং ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এরই মধ্যে শিক্ষা বোর্ডগুলো সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। তবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে সংক্ষিপ্ত পরিসরের এই পরীক্ষা নিয়ে রয়েছে উদ্বেগ ও নানা শঙ্কা।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, ‘মন্দের ভালো সংক্ষিপ্ত পরিসরে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা। এতে হয়তো প্রকৃত মেধার পুরোপুরি মূল্যায়ন নাও হতে পারে, কিন্তু এর চেয়ে ভালো উপায় আর আমাদের হাতে নেই। পাশাপাশি কিছুটা হলেও মেধার মূল্যায়ন হবে।’
আন্তঃ শিক্ষা বোর্ডের সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, ‘আমরা যেভাবেই হোক পরীক্ষা নিতে চাই, যাতে এ বছরের এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের কেউ অটোপাসের অপবাদ না দিতে পারে। এরই মধ্যে আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি। সংক্ষিপ্ত পরীক্ষার জন্য ফরম পূরণ হয়েছে। কেন্দ্র প্রস্তুত করা হচ্ছে। শিক্ষক-কর্মচারীদের টিকা নেওয়াও শেষের পথে। আশা করছি, নভেম্বরে করোনার সংক্রমণ অনেকটাই কমে আসবে। ফলে আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা নিতে পারব।’
জানা যায়, পরিস্থিতি অনুকূলে এলে এবার এসএসসি ও এইচএসসি উভয় ক্ষেত্রেই গ্রুপভিত্তিক তিনটি নৈর্বচনিক বিষয়ে ছয়টি সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা নেওয়া হবে। অর্থাৎ এইচএসসিতে যদি কোনো শিক্ষার্থীর নৈর্বচনিক বিষয় পদার্থ, রসায়ন ও উচ্চতর গণিত থাকে, তাহলে তাকে এই তিন বিষয়ের ছয়টি পত্রে পরীক্ষা দিতে হবে। তিন ঘণ্টার পরীক্ষা হবে দেড় ঘণ্টায়।
রচনামূলক অংশে নম্বর থাকবে ৩৫ ও এমসিকিউ (মাল্টিপল চয়েজ কোয়েশ্চেন) থাকবে ১৫ নম্বরের। তবে প্রশ্নপত্র এখন যেভাবে হয়, সেভাবেই হবে। ফলে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন বাছাই করার ক্ষেত্রে বেশি সুযোগ থাকবে। যেমন আগে যেখানে ১০টি প্রশ্নের মধ্য থেকে আটটির উত্তর দিতে হতো, সেখানে এখন সেই ১০টি প্রশ্নই থাকবে। তবে এর মধ্যে চারটির উত্তর দিতে হবে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন বেছে নেওয়ার সুযোগ বেড়ে যাবে। আর প্রতি বিষয়ে মোট নম্বর ১০০ নম্বরের বদলে ৫০ নম্বরের পরীক্ষা হবে। তবে ৫০ নম্বরকে ১০০তে রূপান্তর করে পরীক্ষার ফল দেওয়া হবে।
এবার আবশ্যিক বিষয় বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ গণিত, আইসিটি ও ধর্ম এবং চতুর্থ বিষয়ের পরীক্ষা নেওয়া হবে না। এসব বিষয়ে পরীক্ষার্থীদের আগের পাবলিক পরীক্ষার সাবজেক্ট ম্যাপিং করে মূল্যায়নের মাধ্যমে নম্বর দেওয়া হবে। এসএসসির ক্ষেত্রে জেএসসি এবং এইচএসসির ক্ষেত্রে জেএসসি ও এসএসসির ফল মূল্যায়ন করা হবে। এসএসসি (ভোকেশনাল)-এ জেএসসি ও নবম শ্রেণি এবং এইচএসসি (ভোকেশনাল)-এ এসএসসি ও একাদশের ফল মূল্যায়ন করা হবে।
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক এইচএসসি পরীক্ষার্থীর অভিভাবক সালাম মৃধা বলেন, ‘ছোট সিলেবাসের পড়া আমার ছেলে অনেক আগেই শেষ করেছে। ওর প্রস্তুতি খুবই ভালো। যে বিষয়গুলোর পরীক্ষা হবে, সেখানে যে ভালো নম্বর পাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু যেগুলোর পরীক্ষা হবে না, সেগুলো নিয়েই চিন্তা। আগের পরীক্ষাগুলোর নম্বর সমন্বয় করতে গিয়ে যদি জিপিএ ৫ হাতছাড়া হয়, তাহলে কষ্টের আর সীমা থাকবে না।’
এ ছাড়া এইচএসসির বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা সাধারণত বায়োলজিকে চতুর্থ বিষয় হিসেবে রাখে। কারণ মেডিকেলে পড়ার জন্য বায়োলজি বিষয়টি থাকতে হবে। এখন যদি বায়োলজিতে পরীক্ষা দিতে না পারে তাহলে তারা কি মেডিক্যালে পরীক্ষা দিতে পারবে, এমন বেশ কিছু প্রশ্ন রয়েছে শিক্ষার্থীদের মনে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সচিব অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, ‘এইচএসসির কোনো শিক্ষার্থীর বায়োলজি চতুর্থ বিষয়, অথচ এসএসসিতে কৃষি শিক্ষা ছিল তার চতুর্থ বিষয়। ওই শিক্ষার্থী এসএসসির চতুর্থ বিষয়ে যত নম্বর পেয়েছিল, এইচএসসির চতুর্থ বিষয় বায়োলজিতেও তাকে একই নম্বর দেওয়া হবে। ওটা তার বায়োলজির নম্বর হিসেবে যুক্ত হবে। তার মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং বা বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব জায়গায়ই ওই নম্বরই গ্রহণযোগ্য হবে। আবশ্যিক বিষয়গুলোতেও একইভাবে নম্বর দেওয়া হবে।’
শিক্ষা বোর্ড সূত্র জানায়, এবার যেহেতু নৈর্বচনিক বিষয়ের পরীক্ষা হবে, তাই কেন্দ্রসংখ্যা বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নেই। প্রতি বেঞ্চে একজন করে শিক্ষার্থী বসিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হবে। আবশ্যিক বিষয় থাকলে যে কেন্দ্রে ৫০০ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা নেওয়া হতো, আবশ্যিক বিষয় থাকায় সেই কেন্দ্রে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা হবে বড়জোড় ১০০ জন। ফলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা নিতে কোনো সমস্যা হবে না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকারি স্কুল-কলেজের প্রায় শতভাগ শিক্ষকই টিকা নিয়েছেন। গত সপ্তাহের হিসাব অনুযায়ী, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তিন লাখ ৬৩ হাজার ২২২ শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে টিকা নিয়েছেন দুই লাখ ৭৮ হাজার ৪২৬ জন। তাই করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে সেপ্টেম্বরের শেষে বা অক্টোবরের শুরুতে এ বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের সরাসরি ক্লাস শুরুরও পরিকল্পনা রয়েছে। সেটা হলে এসএসসির ৬০ কর্মদিবস ও এইচএসসির ৮৪ কর্মদিবসের সংক্ষিপ্ত সিলেবাস পড়ানো হবে। আর এই সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব না হলে অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমেই সংক্ষিপ্ত সিলেবাস শেষ করা হবে। তবে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হলে অ্যাসাইনমেন্টের মূল্যায়ন মূল পরীক্ষায় যোগ করার সম্ভাবনা আপাতত নেই।
কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ বলেন, ‘অটোপাস দেওয়ার চেয়ে এই সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা অবশ্যই ভালো। তবে ছোট সিলেবাসের আলোকে যে পরীক্ষা হবে তা একজন মেধাবী শিক্ষার্থীর এক মাসের পড়া। তবে দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য এই সিলেবাস ঠিক আছে। আর যেসব বিষয়ে পরীক্ষা হবে না, সেগুলো পড়াও শিক্ষার্থীরা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন যেই মেধাবীরা একদিন রাষ্ট্রের হাল ধরবে, তাদের যদি শিখন ঘাটতি থেকে যায়, তাহলে আমরা বিপদে পড়ব। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে, পরীক্ষায় যাই আসুক না কেন, তারা যেন শিক্ষার্থীদের পুরো বই পড়ায়।’
সূত্র: কালের কণ্ঠ।