বদমাইস পোলাপান একটি ইউটিউব সিরিজের নাম। দ্য আজাইরা লিমিটেড নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত এ সিরিজে দেখানো হচ্ছে জুয়ার বিজ্ঞাপন। এ অভিযোগে চ্যানেলটির অন্যতম স্বত্বাধিকারী প্রত্যয় হিরন ও তার দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তারের পর মিলেছে নতুন নতুন তথ্য। পাওয়া গেছে কয়েকজন ব্যক্তির নাম, যারা ইউটিউব, ফেসবুক বা টিকটকে বিভিন্নভাবে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার করে থাকেন। এ ধরনের আরও কয়েকজনকে ধরতে অভিযান চালাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
যারা অর্থের বিনিময়ে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার করে আসছিল তাদের সম্পর্কে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ। যাচাই-বাছাই শেষে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করছে ডিবি উত্তর। এ তথ্য এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছেন ডিবির উত্তর বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মহিদুল ইসলাম।
মহিদুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রেপ্তার প্রত্যয় হিরন ও তার দুই সহযোগী রায়হান সরকার বিশাল ও আব্দুল হামিদের কাছ থেকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। আরও কিছু ব্যক্তির তথ্য আমরা পেয়েছি। যারা জুয়ার বিজ্ঞাপনের কাজে জড়িত বলে অভিযোগ আছে। সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে পরবর্তীতে আমরা অভিযান চালাব।’
আজাইরা লিমিটেডে প্রচারিত বদমাইস পোলাপানের সিজন-৪-এর ২৮ নম্বর এপিসোড চলতে চলতে হঠাৎ জুয়ার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় এভাবে, ‘মামা, বিপিএল তো শেষ হয়ে যাইতেছে। ওকে, …(জুয়ার সাইটের নাম) টাকা ইনকাম করারও অনেক সুযোগ হইতেছে। আর সেখানে চলতেছে গ্রান্ড স্লাম টুর্নামেন্ট। ওইডার ভেতরে বাজি ধরলেই বিএমডাব্লিউ, আইফোন, ল্যাপটপ; আরও অনেককিছু জেতার সুযোগ আছে। আর সাইটের প্রত্যেকটার মধ্যে লাইভ স্কোর দেখতে পারবি। কে কত রান করবে, কে সর্বোচ্চ রান করবে। প্রত্যেকটার ভেতরে তুই অনুমান করে বেট ধরতে পারবি। এ ছাড়া আরও অনেক গেম আছে, যেগুলো খেলে তুই টাকা ইনকাম করতে পারবি…।’
আজাইরা লিমিটেডে প্রচারিত এ সিরিজটির পরিচালক মাবরুর রশীদ বান্নাহ। এনটিভি অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘ওয়েব সিরিজটির ভেতরে জুয়ার বিজ্ঞাপন জুড়ে দেওয়া হলে তাতে আমার কোনো দায় নেই।’
দ্য আজাইরা লিমিটেডের অন্যতম স্বত্বাধিকারী ইউটিউবার প্রত্যয় হিরন। এ ইউটিউবে জুয়া ও বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচারের অভিযোগে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করা হয় রমনা থানায়। মামলা নম্বর ১৩। মামলার পর ওইদিন দিবাগত রাতে অর্থাৎ ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনিসহ তার দুই সহযোগীকে নারায়ণগঞ্জ ও রমনা থানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে ডিবি।
গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে এডিসি মহিদুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রেপ্তারের পর প্রত্যয় হিরন আমাদের কাছে দাবি করেছেন, তিনি জানতেন না; জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার বড় মাপের অপরাধ। তিনি বুঝতে পারেননি বলে জানিয়েছেন। জানলে এ ধরনের কাজ করতেন না। কিন্তু, তিনি তো ছোট না। হয়তো সবই জানেন। কিন্তু, অপরাধ স্বীকার করছেন না।’
মহিদুল ইসলাম আরও বলেন, ‘এসব ব্যাপারে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমরা আদালতের কাছে গ্রেপ্তার প্রত্যেকের জন্য পাঁচ দিন করে রিমান্ড আবেদন করেছিলাম। কিন্তু, আদালত তা নামঞ্জুর করেছেন। ফলে, তাদের তিনজনকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
তবে, প্রত্যয় হিরনকে গ্রেপ্তার করা হলেও তার দ্য আজাইরা লিমিটেডের ওই ইউটিউব চ্যানেলে এখনও জুয়ার বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে।
মহিদুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রেপ্তার আব্দুল হামিদ জানিয়েছেন, মূলত তার মাধ্যমে প্রত্যয় হিরনের সঙ্গে বিজ্ঞাপনদাতাদের পরিচয় হয়। প্রথম কিছুদিন হামিদকে কমিশন দিতেন বিজ্ঞাপনদাতারা। পরে হামিদকে বাদ দিয়ে বিজ্ঞাপনদাতারা প্রত্যয় হিরনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতেন। আর রায়হান সরকার বিশাল এসব কনটেন্টে অভিনয় করতেন।’
গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা জুয়া ও বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপনের কাজে টিকটক, ইউটিউব ও ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতেন। এ ধরনের অন্তত আটটি লিঙ্ক পাওয়া গেছে। তবে, চক্রের মূল প্ল্যাটফর্মের নাম ‘দি আজাইরা লিমিটেড’। চ্যানেলটিতে প্রচারিত ‘বদমাইশ পোলাপাইন সিজন-৪’-এর মাধ্যমে এসব বিজ্ঞাপন বেশি প্রচার করা হতো।
ডিবি সূত্রে জানা গেছে, নিজের কনটেন্টে জুয়া ও বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচারে প্রতি পর্বের জন্য ৭০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা নিতেন প্রত্যয় হিরন। অনলাইনভিত্তিক অন্তত তিনটি জুয়া ও বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচার করতেন প্রত্যয় হিরন ও তার সহযোগীরা।
ডিএমপির রমনা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জয়দেব জয়ধরের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা প্রতারণামূলকভাবে নিজের পরিচয় গোপন রেখে অধিক মুনাফা লাভের আশায় সাধারণ মানুষকে মুনাফার লোভ দেখানো ও ঘরে বসে আয় করার কথা বলে উৎসাহিত করতেন। যা দেখে উঠতি বয়সের যুবকরা জুয়া খেলার দিকে ধাবিত হয়; যা সামাজিক অবক্ষয় সৃষ্টি করে। এর মাধ্যমে দেশ থেকে বিপুল অর্থ বিদেশে চলে যায়।
এজাহারে বলা হয়েছে, গ্রেপ্তার হওয়া প্রত্যয় হিরনের শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি। তার সহযোগী রায়হান সরকার বিশাল এইচএসসি ও আবদুল হামিদ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। তারা তিনজনই ইউটিউবার। তারা তিন বছর ধরে জুয়ার সাইট পরিচালনা ও প্রচার করে আসছেন। তাদের দুজনের বয়স ২২ বছর। আরেকজনের বয়স উল্লেখ করা হয়নি।
প্রতয় হিরন ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচারের অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৩/২৪/২৬/৩০/৩৫ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। সে অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে তার বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড হতে পারে।
এর মধ্যে, ২৩ ধারায় বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণা করেন এবং তা প্রথম বার হলে তকে ৫ বছর কারাদণ্ড এবং ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড দিতে পারবে। আদালত চাইলে তাকে উভয়দণ্ডে দণ্ডিত করতে পারেন। এ ছাড়া একই ধারায় দ্বিতীয় বার বা বারবার অপরাধ করলে ৭ বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
২৪ ধারায় বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো কম্পিউটার, কম্পিউটার প্রোগ্রাম, কম্পিউটার সিস্টেম, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, কোন ডিজিটাল ডিভাইস, ডিজিটাল সিস্টেম বা ডিজিটাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে প্রতারণা করা বা ঠকানোর উদ্দেশে অপর কোনো ব্যক্তির পরিচয় ধারণ করেন বা অন্য কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত কোনো তথ্য নিজের বলে প্রদর্শন করেন তা হলে তিনি অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এ ছাড়া, তিনি ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কোন ব্যক্তি একই ধারায় অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে তিনি ৭ বছর কারাদণ্ডে এবং ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
২৬ ধারায় বলা আছে, কোন ব্যক্তি আইনগত কর্তৃত্ব ছাড়া অপর কোনো ব্যক্তির পরিচিতি তথ্য সংগ্রহ, বিক্রয়, দখল, সরবরাহ বা ব্যবহার করেন, তা হলে তা হবে অপরাধ। সেই অপরাধ করলে তিনি ৫ বছর কারাদণ্ড, বা ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এ ছাড়া, একই ধারায় অপরাধ দ্বিতীয় বার বা বারবার অপরাধ সংঘটন করেন, তাহলে তিনি অনধিক ৭ বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
৩০ ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যাংক, বীমা বা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা মোবাইল আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হতে কোন ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আইনানুগ কর্তৃত্ব ব্যতিরেকে ই-ট্রানজেকশন করেন, বা সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক, সময় সময়, জারিকৃত কোন ই-ট্রানজেকশনকে অবৈধ ঘোষণা করা সত্ত্বেও ই-ট্রানজেকশন করেন, তাহলে উক্ত ব্যক্তির ৫ বছর কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই ধারায় বারবার অপরাধ সংঘটন করলে তিনি ৭ বছর কারাদণ্ডে বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
৩৫ ধারায় বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তি কোনো ব্যাংক, বীমা বা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা মোবাইল আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হতে কোন ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আইনানুগ কর্তৃত্ব ব্যতিরেকে ই-ট্রানজেকশন করেন, বা সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক, সময় সময়, জারিকৃত কোনো ই-ট্রানজেকশনকে অবৈধ ঘোষণা করা সত্ত্বেও ই-ট্রানজেকশন করেন, তা হলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক ৫ বছর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এ ছাড়া, একই ধারায় অপরাধ দ্বিতীয় বার বা বারবার করলে তিনি অনধিক ৭ বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।