ডেস্ক রিপোর্ট :
ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়া বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিকের সোমালিয়ান উপকূলে কেটেছে দুর্বিষহ দিন। নানারকম মানসিক অত্যাচারের শিকার হয়েছেন তারা। আর কখনো স্বজনের কাছে ফিরতে পারবেন কি না- এ উদ্বেগে কেটেছে প্রতিটা মুহূর্ত। মাঝে মাঝে রাতে ফাঁকা গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দে ভেঙে যেত ঘুম। এমনকি মাদকের জন্য দস্যুরা নিজেদের মধ্যেই করত মারামারি-হাতাহাতি। জিম্মি অবস্থায় কাটানো রুদ্ধশ্বাস ৩১ দিনের নানা ঘটনা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে শুনিয়েছেন জাহাজটির ক্যাপ্টেন মো. আতিকুল্লাহ খান। ওইসব ঘটনার চুম্বকাংশ পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হলো- ভারত মহাসাগর থেকে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে জিম্মির ঘটনা বর্ণনা দিয়ে আতিকুল্লাহ খান বলেন, কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত যাওয়ার পথে ভারত সাগরে আমাদের জাহাজ থেকে ১১ নটিক্যাল মাইল দূরে একটি ইরানি মাছ ধরার ট্রলার চিহ্নিত করি আমরা। ওই ট্রলারের অস্বাভাবিক গতিবিধি প্রথম নজরে আসে জাহাজের তৃতীয় অফিসার রোকন উদ্দিনের। ট্রলারটি জাহাজের দিকে আসতে দেখে তিনি সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অবহিত করেন। এটা শুনেই আমরা জাহাজের ব্রিজে চলে আসি। তখন ট্রলার থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করি। এটা দেখে দস্যুরা হাইস্পিড বোটে করে আমাদের ধাওয়া দেয়। তারা যখন কাছাকাছি চলে আসে তখন জাহাজ ‘জিকজ্যাক কোচ’ করা হচ্ছিল, যাতে দস্যুরা জাহাজে উঠতে না পারে। আমরা ব্রিজে গিয়ে দস্যুদের ঠেকানোর চেষ্টা করি। এরই মধ্যে বিভিন্ন নেভি জাহাজকে সহায়তার জন্য বার্তা পাঠানো হয়। কোয়ালিশন ট্রান্সপোর্ট জাহাজের সহায়তার জন্যও চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কারও পক্ষ থেকে সহায়তা পাওয়া যায়নি। এরই মধ্যে অফিসের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়। অফিসের নির্দেশে ‘শিপ সিকিউরিটি অ্যালার্ট সিস্টেম’ চালু করা হয়। সঙ্গে ইউকে এমটিকেও ফোন দেওয়া হয়। তিনবার রিং হওয়ার পরও তারা ফোন রিসিভ করেনি। দস্যুদের স্পিডবোট জাহাজের কাছাকাছি এলে আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করেছি তাদের ঠেকাতে। কিন্তু আমাদের এক নাবিককে জিম্মি করার পর আমাদের আর কিছু করার ছিল না। জিম্মি হওয়ার পর আমরা সবাই আতঙ্কিত হয়ে যাই। কিন্তু আমরা কৌশলী আচরণ করায় তারা শারীরিকভাবে কাউকে আঘাত করেনি। আতিকুল্লাহ বলেন, জিম্মি করার পর দস্যুরা আমাদের মোবাইল কেড়ে নেয়। কিন্তু আমরা কৌশলে কয়েকটি মোবাইল লুকিয়ে রাখি। সুযোগ পেলেই ওই মোবাইল দিয়ে পরিবার-পরিজন এবং জাহাজের মালিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতাম। মালিক কর্তৃপক্ষ আমাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে মুক্ত করার আশ্বাস দেয়। ইন্টারনেট সুবিধাসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে। এতে আমাদের কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। বিশেষ করে বিভিন্ন সময়ে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়। এত দ্রুত মুক্তি পাব তা চিন্তা করেনি। মালিক পক্ষ, সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিকতার কারণে আমরা দ্রুত মুক্ত হয়েছি, এটাই বড় পাওয়া।
তিনি বলেন, জাহাজে মাদক নিয়ে প্রায়ই বিবাদে জড়িয়ে পড়ত দস্যুরা। এজন্য সরদার তাদের শাস্তিও দিতেন। জাহাজ জিম্মি করার সময় ভারী অস্ত্র নিয়ে ১২ জন দস্যু জাহাজে ওঠে। উপকূলে যাওয়ার পর এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ জনে। সর্বশেষ জাহাজে ৬৫ জন জলদস্যুর অবস্থান ছিল। উপকূলে নোঙর করার পর স্পিডবোটে করে জাহাজে আসত দস্যুরা। আসার সময় তারা খাবার, দস্যুদের জন্য নতুন কাপড় এবং ‘খাট’ নামক মাদক নিয়ে আসত। এ মাদক খেয়ে দস্যুরা টানা তিন-চার দিন না ঘুমিয়ে কাটাতে পারে। মাদক শেষ হয়ে এলে দস্যুরা নিজেদের মধ্যে বিবাদে জড়িয়ে পড়ত। ফাঁকা গুলি ছুড়ত। তখন সরদার এসে তাদের শান্ত করত। বিবাদে জড়িয়ে পড়া দস্যুদের শাস্তি দিত। আতিকুল্লাহ বলেন, জিম্মি হওয়ার প্রথম ১০ দিন দুর্বিষহ দিন কাটে আমাদের। এ দিনগুলোতে মানসিকভাবে নির্যাতন করত দস্যুরা। আমাদের খাবারে ভাগ বসাত। প্রচুর পানি নষ্ট করত। তখন বুদ্ধি করে আমরা দস্যুদের সঙ্গে ভালো আচরণ করি। ভালো সম্পর্ক তৈরি করি। এরপর পাল্টে যেতে থাকে তাদের আচরণ। ‘ভালো সম্পর্ক’ তৈরি হওয়ার পর তারা বাইরে থেকে খাবার এনে খেত। মাঝে-মধ্যে আমাদেরও তাদের খাবার দিত। তবে রমজান মাস হওয়ায় খাবার নিয়ে আমাদের অনেক সুবিধাই হয়েছে। রোজা রাখছি শুনে আমাদের ওপর চাপ দেওয়া অনেকটাই কমিয়ে দেয় দস্যুরা। দিনের বেলায় অবাধ ঘোরাঘুরির সুবিধা দেয়। কিন্তু রাতে থাকত কড়াকড়ি। ঈদের নামাজ সবাই মিলেই পড়ি। কিন্তু ঈদের নামাজের পর ছবি ভাইরাল হয়ে গেলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এ সময় ইন্টারনেট সংযোগ বেশকিছু সময়ের জন্য বিচ্ছিন্ন করে দেয়। আতঙ্কের রাতগুলোর বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, মাঝে মাঝে রাতে ভয়ংকর শব্দে আমাদের ঘুম ভাঙত। দস্যুরা মনে হয় তখন সাউন্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটাত। বিস্ফোরণের শব্দে পুরো জাহাজ কেঁপে উঠত। তখন খুবই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ত সব নাবিক। আমাদের জাহাজ ছাড়াও পাশে আরেকটা জাহাজ ছিল। সম্ভবত এ দস্যু গ্রুপ ওই জাহাজটিকেও জিম্মি করেছে। এ জাহাজের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারিনি।