দৃশ্যত হারিয়ে গেছেন আমাদের জাতির পিতা। ফিরে এসেছেন বিপুল হয়ে। সতত করে নামগান। তাঁর কীর্তি ও কর্মের আলোয় উদ্ভাসিত বাঙালি। কবি শামসুর রাহমানের কথায়,
‘ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর রৌদ্র ঝরে
চিরকাল, গান হয়ে
নেমে আসে শ্রাবণের বৃষ্টিধারা; যাঁর নামের ওপর
কখনো ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া,
ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর ঝরে
মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি।’
পিতাকে নিয়ে লেখা এ কবিতা পুরোনো হয় না। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, পিতার নাম আর মুক্তিযুদ্ধের অমর স্মৃতি স্মরিত হবে ততদিন।
১৭ মার্চ ১৯২০ গোপালগঞ্জের নিভৃত গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন জাতির পিতা শেখ মুজিব। ডাক নাম খোকা। পিতা শেখ লুৎফর রহমান, মাতা সায়েরা খাতুন। স্থানীয় গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক স্কুল, গোপালগঞ্জ সীতানাথ একাডেমি, মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুল, কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজে পড়াশুনা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। ছেলেবেলা থেকেই আপোশহীন মনোভাব ছিল। মানুষের প্রতি ছিল অপরিসীম দরদ। দেশের জন্য ভালোবাসা আর জাতীয় নেতাদের সাহচর্যে তাঁর মধ্যে শৈশবেই নেতৃত্বের গুণাবলী বিকশিত হতে থাকে। মুজিব, মুজিব ভাই থেকে শুরু করে একসময় তিনি হয়ে ওঠেন জাতির পিতা। বঙ্গবন্ধু খেতাবে ভূষিত হন।
জীবনের অর্ধেক সময় জেলে কাটিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বে অর্জিত হয়েছে দেশের স্বাধীনতা। স্বাধীন দেশে জাতি গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। নিজের দিকে ফিরে তাকাননি ক্ষণেকের জন্য। সম্পদ বলতে ছিল জনগণ এবং তাদের ভালবাসা। কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করতে পারে এমন আশঙ্কা বঙ্গবন্ধুর মনে বিন্দুমাত্র ছিল না। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও ঘনিষ্ঠজনের অনুরোধ উপেক্ষা করে রাষ্ট্রপতি হয়েও বঙ্গভবনের মতো সুরক্ষিত স্থানে না থেকে থেকেছেন ধানমন্ডিতে অরক্ষিত নিজবাড়িতে।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে সারা জাতি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, কাঁদতে পারেনি ভয়ে। বুকে পাষাণ ভার। তবু যেন চোখ থেকে পানি পড়া নিষেধ, আর্তি আহাজারি করা বারণ। যে সঙ্গীন কেড়ে নিয়েছিল জাতির পিতা আর তাঁর পুরো পরিবারকে, সে সঙ্গীনের ভয়ে কাঁদতে পারেনি বাঙালি জাতি। শুধু যাদের বুকে সঙ্গীন ধরা যায় না সেই স্বাধীন দেশের আকাশ বাতাসে ধূলিকণা কেঁদেছিল, বাঙালি ফেলেছিল নীরব দীর্ঘশ্বাস।
কী ভয়ঙ্কর, কী নিষ্ঠুর আর কী ভয়াল ছিল সেই দিন রাত। ওই রাতে স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, ১০ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধু সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল, সহোদর, আত্মীয় পরিজন ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্মচারীসহ নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন জাতির পিতা।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নারী, শিশু ও বৃদ্ধাসহ নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছিল একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে গণহত্যা চালালো পাকিস্তানি হানাদারদের এদেশীয় দোসর কিছু বিশ্বাসঘাতক, যারা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী কিছু দল। নারকীয় এই সেনা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনার প্রধান হোতা ছিলেন শেখ মুজিবের সহকর্মী খন্দকার মুশতাক আহমেদ, যিনি তার স্থলাভিষিক্ত হন। সাথে ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। প্রবাসে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।