বিজ্ঞপ্তি:
দৈনিক শাহনামার অনলাইন ভার্সনে আপনাকে স্বাগতম। জাতীয়, রাজনীতি, খেলাধুলা, বিনোদন সহ সকল সংবাদের সর্বশেষ আপডেট জানতে ভিজিট করুন www.shahnamabd.com

আমাদের একজন হিরন ছিল

আমাদের একজন হিরন ছিল

৯ এপ্রিল ২০১৪ শুক্রবার  দুপুর ১২টা। সবাই হাঁটছেন বিভিন্ন সড়ক ধরে। বেলা একটায় সদর রোড, বাংলাবাজার, জীবনানন্দ দাশ সড়ক, পুলিশ লাইন, বান্দ রোডসহ আশপাশের সব সড়কে মানুষের ঢল। লক্ষ্য, বঙ্গবন্ধু উদ্যান। না, কোনো জনসভা নয়। বদলে দেওয়া বরিশালের রূপকার, কল্পনাবিলাসী রাজনীতির স্বপ্নপুরুষ জননেতা  শওকত হোসেন হিরনের জানাজায় অংশ নেওয়ার জন্য। মানুষকে ভালোবেসে হিরন যেন হিরণ্ময় জ্যোতি ছড়িয়েছেন বরিশাল নগরজুড়ে।

মানুষের জন্য ভালোবাসার প্রতিদান এমন হতে পারে, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কষ্ট। শুধু বরিশাল নয় পুরো দখিনা জনপদ থেকে যে যেমন পেরেছেন ছুটে এসেছেন। দোকানদার, ব্যবসায়ী, রিকশাশ্রমিক, শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক কর্মী, রাজনৈতিক নেতা—সবাই এসেছেন প্রিয় মানুষ হিরনকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে।

কেন এই মানুষের ঢল? কেন এই জনসমুদ্র? কী ছিলেন হিরন, কী কাজ করেছেন বরিশাল নগরের জন্য? কিসের প্রতিদান দিতে চৈত্রের রোদ উপেক্ষা করে মানুষের স্রোত বঙ্গবন্ধু উদ্যানে। মাত্র তো সাড়ে চার বছর বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন। এর আগে তো অনেকে পৌর চেয়ারম্যান থেকে মেয়র পর্যন্ত হয়েছেন। এখনো নির্বাচিত আছেন। তাঁদের ত্রুটি কোথায়? এমন সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন বরিশালের সাধারণ মানুষ।

৯ এপ্রিল হিরনের মরদেহ তখন বরিশালে পৌঁছেছে। তাঁকে দেখতে হাজার হাজার মানুষ ছুটছেন তাঁর বাসভবনের দিকে। রাস্তায় এক ব্যক্তি বলে উঠলেন, মেয়রের বাড়ি এদিক থেকেও যাওয়া যায়। হিরন বর্তমানে মেয়র নন—এই সত্য বরিশালের বাসিন্দারা জানেন, তবে মানেন না। তাই তো আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা অন্য যেকোনো দলের কর্মী ও সাধারণ মানুষের মুখে হিরন হয়ে ওঠেন মেয়র হিরন। সেই নামেই পরিচিতি ঘটে তাঁর।

নগরের যেখানেই চোখ যায়, হিরনের কাজের ছাপ। বর্তমানে বরিশাল নগরে সবুজ বৃক্ষও অর্ধেকের বেশি হিরনের লাগানো। স্বপ্ন ছিল সবুজের নগর তৈরির। রাস্তায় টিস্যু, থুতু ফেলতে নিষেধ করতেন হিরন। সবাইকে নিজের আঙিনা পরিচ্ছন্ন রাখার তাগিদ দিতেন। সূর্য ওঠার আগে নগরের আবর্জনা সরিয়ে নিয়েছেন তিনি। ৩০ ওয়ার্ডের বাড়ি বাড়ি থেকে বাঁশি বাজিয়ে ময়লা অপসারণের উদ্যোগও তাঁর। নগরে বালুর গাড়ি চলাচলে নিষেধাজ্ঞা এবং রাত জেগে তার তদারক করেছেন হিরন। নগরের সড়ক প্রশস্তকরণ, আলোর নগরে পরিণত করা, ফুটপাত নির্মাণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, বিনোদনকেন্দ্র, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা—সর্বত্র অবদান ছিল হিরনের। তাই তো হিরন সবার কাছে এত প্রিয় হয়ে ওঠেন।

ছয় বছর আগে যাঁরা বরিশালে এসেছেন, তাঁরা দেখেছেন, একটি দুর্গন্ধ জঞ্জালের নগর ছিল বরিশাল। সেই সব জঞ্জাল সরিয়ে বরিশাল নগরকে নান্দনিক সৌন্দর্য দিয়েছেন হিরন। দলমত-নির্বিশেষে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টিতে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তিনি।
২০১৩ সালে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি সম্মেলন উপলক্ষে নগরে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনাসহ দলের নেতা-কর্মীদের বিলবোর্ডে ছেয়ে যায়। দুই দিন পর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বরিশালে আসেন জনসভা করার জন্য। শওকত হোসেন হিরন ওই জনসভা সফল করার জন্য দলের সব বিলবোর্ড সরিয়ে ফেলেন। সেই সব স্থানে মুহূর্তের মধ্যে খালেদা জিয়াসহ দলের নেতাদের ছবি, বিলবোর্ড স্থান পায়। ওই জনসভা যাতে সফল হয়, সে জন্য আগের দিন বঙ্গবন্ধু উদ্যানে বিএনপির জনসভাস্থল পরিদর্শন করেন। বরিশালের ইতিহাসে কোনো ধরনের হামলা ও সহিংসতা ছাড়া বিএনপির ওই জনসভা সফল হয়।

২০০১ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সারাদেশের ন্যায় বরিশালে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাস, বিরোধী  দলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের সব ঘটনা বন্ধ হয়ে যায় হিরন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর। পাশাপাশি অবস্থান করে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও অন্যান্য দল রাজনীতি করেছে। হামলা-মামলার ঘটনা এখন শূন্যে দাঁড়িয়েছে হিরনের কল্যাণে। বর্তমানে বরিশাল নগর শান্তির নগর হিসেবে পরিচিত। শুক্রবার জানাজা শেষে তৎকালীন  শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেছেন, সন্ত্রাসের বরিশাল শান্তির বরিশালে রূপান্তর করেছেন হিরন।

আওয়ামী লীগ সম্পর্কে ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকলেও হিরন ছিলেন নগরবাসীর প্রাণের মানুষ। জানাজায় যাওয়া এক ব্যবসায়ী বলেন, আজ তো চকে কোনো মানুষ নেই। দোকান বন্ধ করে সবাই এসেছে হিরনের জানাজায়। বঙ্গবন্ধু উদ্যানের দক্ষিণ প্রান্তে কয়েক যুবক রোদে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন, বরিশালে এত খারাপ মানুষ থাকতেও হিরন ভাই চলে গেল? তাহলে বরিশালের কী হবে? কে করবে উন্নয়নকাজ?

পূর্ব পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন কয়েকজন বয়স্ক লোক। তারা একে অপরকে ধরে বিলাপ করে বলছিলেন, ‘আমরা কি অভাগাই থাকব? ৫০ বছরেও বরিশালের কোনো উন্নয়ন হলো না। যে মানুষটা মাত্র কয়েক বছরে নগরের রূপ বদলে দিল, সেই মানুষটা আমাদের মাঝে নেই। এটা কেমন বিচার বিধাতার।’ সেদিন এমন কান্নার শব্দ ছিল বঙ্গবন্ধু উদ্যানসহ পুরো নগরে।সেদিন এমন কান্না ছিল বরিশাল নগর ছাড়িয়ে পুরো দখিনা জনপদে। স্বজন হারানোর কান্না, ভাল বাসার মানুষের জন্য কান্না স্বপ্ন সারথী এক আপনজনের জন্য কান্না। ১৯৬২ সালে গনতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পর বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক নেতার জন্য এভাবে কেউ কাউকে কাদঁতে দেখেনি।

আজ রাজনীতির স্বপ্নপুরুষ জননেতা শওকত হোসেন হিরনের ৬ষ্ঠ মৃত্যু বার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।

()সংকলিত)

Please Share This Post in Your Social Media




All rights reserved by Daily Shahnama
কারিগরি সহায়তা: Next Tech