শান্ত পরিবেশ, মুক্ত বাতাস নেই কোন হৈ চৈ খোলা সীবিচ। সাগার কন্যা কুয়াকাটা সৈকত লাগোয়া পরিস্কার পানিতে নির্বিঘ্নে সাঁতার কাটছে ছোট ছোট মাছের ঝাকঁ। আশির দশকে সারা বছরই এখানে দেখা মিলত এরকম মাছের ঝাঁক। পাখিদের কলরবে মুখরিত থাকত গোটা এলাকা। ধুধূ বালির চরে লাল কাঁকড়ার ছোটাছুটি। বনজঙ্গলে ছিলো একাকার বালুর কেল্লা তার উপর লতাবরা গাছ,ছিলো প্রতিটি কেল্লার পর এক একটি বড় বড় ফাঢ়ি। কিন্তু সম্প্রতিকালে পর্যটকদের আনাগোনা, যন্ত্রচালিত ট্রলারের গর্জনে অদৃশ্য হয়ে যায় তারা। লকডাউনে কুয়াকাটা এখন টানাবন্ধ। দূষণ নেই সাগরের পানিতে। সাগর তীরের বাসিন্দারা বলছেন, আবার বীচলাগোয়া পানিতে মাছের আনাগোনা বেড়েছে। বীচে নেই ময়লা-আবর্জনা। আশার খবর শুনিয়েছেন পরিবেশবিদেরাও। তারা বলেন কুয়াকাটা আবার ফিরেছে তার পুরানো যৌবনে।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ১৮ কিলো. কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ সৈকতও রূপ বদলায়। শীতের কুয়াকাটা শান্ত, বর্ষায় তা উত্তাল। পর্যটকদের কাছে এর আলাদা আবেদন রয়েছে। কারন এই সৈকত থেকে সুর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। তাই কুয়াকাটা সারাবছরই দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদচারনে মুখরিত থাকে।
১৯৯৮ সালে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে ঘোষণার পর থেকে সারা বিশ্বের পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কুয়াকাটা। বিনিয়োগকারীরাও ছুটে এসে হোটেল-মোটেলসহ স্থাপনা নির্মাণ শুরু করে । কুয়াকাটাকে সৌন্দের্যের নগরী হিসেবে গড়ে তোলার হচ্ছে। কুয়াকাটার সৈকত ঘেঁষা নারিকেল বাগান. তাল বাগান ও জাতীয় উদ্যানের ঝাউবাগান পর্যটকদের আরো আকৃষ্ট করে তোলার চেষ্টা চলে।
পরবর্তীতে কুয়াকাটায় পর্যটকদের কাছে আকর্ষনীয় হয়ে উঠে। দিনদিন পর্যটকদের আগমনে শান্ত পরিবেশের কুয়াকাটা ব্যস্ত নগরীতে পরিনত হয়। সৈকত লাগায়ো হোটেলের বর্জ, প্লাস্টিকের বোতল, ময়লা-আবর্জনার দুগন্ধে সৈকতের পরিবেশ দূষণ হয়ে ওঠে। পাশাপাশি সৈকলে যানবাহন চলাচল, সৈকত সংলগ্ন সাগরে ইঞ্জিন চালিত ট্রলারের অবাধ চলাচল জীববৈচিত্রর ওপরও প্রভাব পড়েছে। এক সময় সৈকতে লালকাকড়ার ছোটাছুটি লুকোচুরি খেলা দেখা গেলেও মানুষের পদচারনে তা হারিয়ে গিয়েছে।
করোনারভাইরাসের হুমকির কারণে ১৭ মার্চ থেকে পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসন কুয়াকাটায় পর্যটকদের যানচলাচল নিষিদ্ধ করেছে। পরবর্তীতে পুরো জেলা লকডাউন ঘোষনা করা হয়েছে। শুক্রবার সরেজমি গিয়ে দেখা যায়, কুয়াকাটায় পর্যটকদের উপস্থিতি নেই। হোটেল-মোটেল, দোকানপাট বন্ধ । পরিস্কার পরিচ্ছন্ন সৈকত, নেই কোথাও ময়লা আবর্জনা। নেই কোনো পরিবেশ দূষণ, প্রকৃতি চলছে আপন গতিতে, প্রকৃতির ক্ষতি বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার মানুষটি বাহিরে নেই। সৈকত লাগোঁয়া সাগরের নেই কোনো অবৈধ জালের অস্তিত্ব বা জীব বৈচিত্র্যে নেই নিষ্ঠুর মানুষের থাবা। সাগরের ঢেউয়ের তালে তালে ছোট ছোট বিভিন্ন প্রজাতির মাছের দলের ছোটাছুটি চোখে পড়ে।
সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা,লেম্বুর, গঙ্গামতি এং কাউয়া চর পয়েন্টে গেলেই এখন লাল কাঁকড়া চোখে পড়বে। সন্ধ্যা বেলায় ভাটার সময় সমুদ্র সৈকত থেকে জল যখন নামতে শুরু করে . তখন অসংখ্য লাল কাঁকড়া ছুটে চলা মিছিলে পুরো সৈকত জুড়ে আলপনার মতো ফুটে ওঠে। এসময় মনে হবে কাঁকড়াগুলো সেই জমিটি পুনরুদ্ধার করছে, যা দীর্ঘদিন থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিলএবংতারা প্রান হারিয়েছিল।
কুয়াকাটা ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট এ্যাসোশিসেন (কুটুমের) সম্পাদক মজিবর রহমান বলেন, কুয়াকাটার সৌন্দর্য্যই পর্যটকদের কুয়াকাটায় টেনে নিয়ে আসে। তবে পর্যটকদের অনুপস্থিতিসহ সকল কিছু বন্ধ থাকায় কুয়াকাটা তার নিজের রুপ ফিরে পেয়েছে। পর্যটকদের আগমনের পরও যেন এভাবে কুয়াকাটার সৌন্দর্য ধরে রাখা যায় সেই উদ্যোগ নিতে হবে। এতে কুয়াকাটা পর্যটকদের কাছে আরেও আকর্ষনীয় হয়ে উঠবে ।
কুয়াকাটা পৌর মেয়র আবদুল বারেক মোল্লা দৈনিক বলেন, কুয়াকাটাকে নিয়ে সরকার ব্যাপক উন্নয়নের পরিকল্পনা নিয়েছে। তবে আজকের এই কুয়াকাটার সৌন্দর্য আসলেই সে তার নিজের রুপে ফিরে এসেছে। আমারা চাইবো এই প্রকৃতি ধরে রেখেই কুয়াকাটার উন্নয়ন কার্যক্রকে এগিয়ে নেবো।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ, একোয়াকালচার এন্ড মেরিন সায়েন্স অনুষদের একোয়াকালচার বিভাগের প্রভাষক মীর মোহাম্মদ আলী কুয়াকাটা সম্পর্কে সাংবাদিকদের বলেন, এই সময়ে পর্যটক না থাকায় বিচ ও বিচের কিনারার পানিতে বিভিন্ন ধরনের দূষণ ও মানুষের উপস্থিতি নেই। এর ফলে জলজ উদ্ভিদ ও কিনরায় প্রচুর পরিমাণ মাছের আধিক্য থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। আমাদের সকলের উচিৎ এই লকডাউন পরবর্তী, এই কুয়াকাটাকে নতুন ভাবে সাজানো, উপকূলে যে কোন ধরনের প্লাষ্টিক ও ময়লা আবর্জনা না ফেলার জন্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়া,পর্যবেক্ষণ করা ও অমান্য করলে শাস্তির ব্যবস্থা করা।
বিচের সৌন্দর্য ধরে রাখতে বিচে নর্দিষ্ট স্থানে ময়লার ঝুড়ি রাখা এবং বাধ্যতামূলক করে নির্দিষ্ট জায়গায় ময়লা ফেলার ব্যাবস্থা করা। পাশাপাশি উপকূলের বেহুন্দী ও ছোট ফাঁসের জাল, যেগুলো মাছের পোনাসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে সেগুলো ব্যবহার না করার কঠোর ব্যাবস্থা নেওয়া। প্রশাসনের পাশাপাশি জনসচেতনতায়,বিভিন্ন বিলবোর্ড ব্যবহার করা যেতে পারে। তাহলে আজকের সুন্দর কুয়াকাটা দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষনীয় হবে, বেঁচে যাবে প্রাকৃতিক সম্পদ ও আমাদের প্রকৃতি, মানুষ দেখতে পাবে আজকের এই স্বাভাবিক, সুস্থ ও সুন্দরপরিবেশ।