‘আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইয়েদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।’ আনন্দ-বেদনার অশ্রুধারা চোখে নিয়েই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে এভাবে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছিলেন।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েই দেশের মাটিতে পা রাখার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। লন্ডন ও নয়াদিল্লি হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরেন তিনি।
বাঙালি জাতির জন্য দিনটি ছিল মহা উল্লাসের। ওইদিন তেজগাঁও বিমানবন্দর এলাকা ‘জয় বাংলা’ কলরবে মুখরিত হয়ে ওঠে। নিজ দেশে ফিরে বাবা-মা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের কাছে না গিয়ে সরাসরি জনগণের কাছে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু।
বিমানবন্দর থেকে সোজা চলে যান রেসকোর্স ময়দানে। ৭ কোটি বাঙালির উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বিজয়ের বার্তা ছুড়ে দেন। দেশ গঠনে সবাইকে উদ্বুদ্ধ হয়ে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান। বিকেল ৫টায় শুরু হওয়া বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণে রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
পরের দিন দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদসহ বিভিন্ন পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে লেখা হয়, ‘স্বদেশের মাটি ছুঁয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের নির্মাতা শিশুর মতো আবেগে আকুল হলেন। আনন্দ-বেদনার অশ্রুধারা নামলো তার দু’চোখ বেয়ে। প্রিয় নেতাকে ফিরে পেয়ে সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালি আনন্দাশ্রুতে সিক্ত হয়ে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনিতে প্রকম্পিত করে তোলে বাংলার আকাশ বাতাস।’
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে সেদিন তিনি ঐতিহাসিক ওই বক্তৃতায় বলেন, ‘যে মাটিকে আমি এত ভালবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালবাসি, যে জাতিকে আমি এত ভালবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারবো কি-না। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইয়েদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।’
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশের সাধারণ মানুষের ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। এক রাতেই ঢাকা শহর পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার আগেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান, যার পথ ধরে শুরু হয় বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ।
বাঙালিরা যখন স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধরত; বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে প্রহসনের বিচারে ফাঁসির আসামি হিসেবে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন। বাঙালিদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হওয়ার পর বিশ্বনেতারা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। পরাজিত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আন্তর্জাতিক চাপে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের লক্ষ্যে ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে ২৬ মার্চ ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়কে সরকার ‘মুজিব বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস থেকেই শুরু হয় মুজিব বর্ষের ক্ষণগণনা।
শুধু সরকার নয়, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপনের ঘোষণা দেয় জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থাও। তবে বৈশ্বিক মহামারির কারণে মুজিব বর্ষ উদযাপনে নেওয়া কার্যক্রমগুলো এখনো সম্পন্ন হয়নি। এ কারণেই মুজিব বর্ষের মেয়াদ আগামী ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।