হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন যে কারণে জীবদ্দশাতেই জীবনের অবশিষ্ট অধ্যায় লিখে যেতে চেয়েছিলেন। সাবেক এই রাষ্ট্রপতি নিজেই বইটির নামকরণ করেছিলেন ‘আমার জীবনের অবশিষ্ট অধ্যায়’। বইটির কম্পোজ, প্রচ্ছদ, ডিজাইন শেষে প্রুফ দেখার কাজও শেষ করে আনেন। কিন্তু হঠাৎ লাইফ সাপোর্টে চলে যাওয়ায় আর প্রিন্ট দেখে যেতে পারেন নি।
২০১৯ সালের ১৪ জুলাই না ফেরার দেশে চলে যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। মাস হিসেব করলে ১৮ মাসের পেরিয়ে গেছে। যেখানে রেখে গিয়েছিলেন, সেখানেই রয়ে গেছে। একবার বলা হয় টাকার অভাবে প্রিন্ট হচ্ছে না, প্রকাশক বলেন তিনি বিনা খরচে প্রিন্ট করতে চান। অনুঘটন সুনীল শুভরায় বলেন এক রকম কথা, আবার জাতীয় পার্টির বর্তমান কর্ণধার জিএম কাদের বলেন আরেক কথা।
বইটির পুরোপুরি অনুলিখনের কাজ করেছেন প্রয়াত এরশাদের দীর্ঘদিনের সহযোগী প্রেস ও পলিটিক্যাল সেক্রেটারি সুনীল শুভরায়। এরশাদের প্রথম জীবনী গ্রন্থ ‘আমার কর্ম আমার জীবন’ যা (২০১৬ সালে প্রকাশিত) সুনীল শুভরায় অনুলিখন করেন। বইটি প্রিন্ট না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে, সুনীল শুভরায় সরাসরি কোনো উত্তর দেননি। তিনি বলেছেন, বইটি প্রায় রেডি। শেষ দিকের কিছু অংশ যুক্ত হবে। পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান সময় পাচ্ছেন না, তিনি একবার দেখে দিলেই প্রিন্টে চলে যাবে।
অন্যদিকে পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের কে বলেছেন, বইটির বিষয়ে দেখছেন সুনীল শুভরায়। তার সঙ্গে কথা বলে জানতে হবে।
মাঝে কিছু দিন বলা হতো অর্থ সংকটের কারণে প্রিন্ট করা যাচ্ছে না। তবে সাধারণ কর্মীরা এটি মানতে নারাজ। তারা মনে করছেন এরশাদ অনেকটা অনাদরে থাকছে শীর্ষনেতাদের কাছে। যতটুকু নিজেদের জন্য প্রয়োজন সেটাই করছেন। তা যদি নাই হবে তাহলে প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতেও পার্টি কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো পোস্টার হলো না কেনো।
জাতীয় পার্টির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, দেখেন আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সামনে রেখে রাজনীতি করছে। বিএনপি জিয়ার আদর্শকে ক্যাশ করে রাজনীতি করছে। জাতীয় পার্টিকেও বাঁচতে হলে এরশাদের আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। জাতীয় পার্টি কিন্তু সেই কাজটি যথাযথ ভাবে করতে পারছে না। এমন হলে জাতীয় পার্টি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে।
ওই প্রেসিডিয়াম সদস্য আক্ষেপ করে বলেন, এরশাদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে জাতীয় পার্টি কোনো পোস্টার করেনি। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির ক্ষেত্রে এমনটি কল্পনা করা যায়। মৃত্যুবার্ষিকীর কর্মসূচি অনেক জেলায় দায়সারা গোছের পালিত হয়েছে। জন্মদিনের কর্মসূচি নিয়েও সন্তুষ্ট নয় তৃণমূল। প্রিয় নেতা এরশাদ হয়তো আঁচ করতে পেরেছিলেন তাই হয়তো জীবদ্দশায় বইটি প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। বিধাতা তাকে সেই সময়টুকু দিলেন না।
জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এরশাদকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়ে এসেছে। আয়-ব্যয় সবই ছিল এরশাদ কেন্দ্রীক। এরশাদ মারা যাওয়ার পুর্বেই তার সকল স্থাবর অস্থাবর ট্রাস্টের নামে লিখে দিয়েছেন। সেই ট্রাস্টও এখন পুরোপুরি জাতীয় পার্টি তথা জিএম কাদেরের হাতছাড়া। পুরো ট্রাস্টের কলকাঠি নাড়ছেন বিদিশা। আবার নানা কারণে বিশেষ অনুদানের প্রবাহও কমে গেছে। প্রকৃত অর্থেই জাপা কিছুটা আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে বই প্রকাশ করতে পারবে না এতোটা খারাপ নয়। সদিচ্ছার অভাব দেখছেন নেতাকর্মীরা।
অবশ্য এই বইটি এরশাদের প্রথম জীবনী গ্রন্থ নয়। ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়েছে ‘আমার কর্ম আমার জীবন’। ওই বইয়ে স্থান পেয়েছে তার বেড়ে ওঠা, স্কুল জীবন, সেনাবাহিনীতে প্রবেশ, রাষ্ট্রপতি হওয়া, ক্ষমতা হস্তান্তরের পর জেলে যাওয়া এবং জেল থেকে মুক্তি পর্যন্ত। ৮৬৪ পৃষ্ঠার বইটিতে অনেক অজানা তথ্য তুলে ধরেছেন।
প্রথম বইয়ে জীবনের প্রথম (নায়িকার নাম প্রকাশ না করে) প্রেম পত্রের চিঠির অনুভূতি। সেই চিঠির ভেতরে থাকা গোলাপের পাপড়ির ঘ্রাণ। চিঠির সেই নায়িকা প্রতি আকর্ষণের কারণে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই প্রেয়সীর সাড়া না মেলায় বেশিদূর এগুতে পারেন নি। অকপটে তুলে ধরেছেন তার সেসব অনুভূতির কথা।
আবার জীবনে প্রথম অন্যের টাই পরে চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়া, চাকরিতে যোগদান, রওশনের বাবার সঙ্গে টেনিস খেলা থেকে কিভাবে পরিণয় সবই তুলেছেন তার প্রথম বইয়ে।
‘আমার জীবনের অবশিষ্ট অধ্যায়’ এ স্থান পেয়েছে জেল থেকে বের হওয়ার পর তার রাজনীতি, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট। থাকছে নানা রকম ঘটনা প্রবাহ ও জাপার ভাঙা গড়ার নানা রকম উত্থান পতন। বইটির প্রচ্ছদে এরশাদের কোট টাই পরা পোর্টেট ছবি। আর পেছনের প্রচ্ছদে গোধুলীলগ্নে চিন্তমগ্ন এরশাদের সাদাকালো ছবি প্রয়াত এই রাষ্ট্রপতি নিজেই পছন্দ করেছিলেন। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮৩২টি নির্ধারিত ছিল।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রেস ও পলিটিক্যাল সেক্রেটারি সুনীল শুভরায় বইটির অনুলিখন করেছেন। এরশাদের দীর্ঘ সময়ের এ সহযোগী জানুয়ারি মাসে বলেছিলেন, বইটির কম্পোজ শেষ, এখন ফিনিসিং দেখা হচ্ছে। ঈদের আগেই প্রকাশ করার চেষ্টা চলছে। আগের বইটিও আকাশ প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়। এবারও কাজটি করছেন আকাশ প্রকাশনা সংস্থা।
কি কি স্থান পাচ্ছে বইটিতে, এমন প্রশ্নের জবাবে সুনীল শুভরায় বলেন, জেল থেকে মুক্তির পর ২০১৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত। অনেক অজানা সত্য জানতে পারবে পাঠক। তবে এরপরও কিছু সেন্সর থেকেই যায়। কারণ সব কথা বলা সম্ভব হয় না।
অপর একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। কিভাবে জাতীয় পার্টিকে ভাঙা হয়েছে। তার দলের সদস্যের মন্ত্রিসভায় থাকা না থাকার বিষয়। এরশাদ কি চেয়েছিলেন আর কি হয়েছে অনেকখানি খোলাসা করার চেষ্টা হয়েছে।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আকাশ প্রকাশনা সংস্থার স্বত্বাধিকারী আলমগীর সিকদার লোটন বলেছেন, আমাকে যদি দায়িত্ব দেয় আমার ব্যক্তিগত খরচে করে দিতে আগ্রহী আছি। প্রয়াত এরশাদের কারণে আমি আজকের লোটন হতে পেরেছি। তার প্রতি অনেক ঋণ রয়ে গেছে।