করোনা সংক্রমণের মধ্যেই রাজধানীতে বেড়েছে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। প্রতিদিনই হাসপাতলগুলোতে শক সিন্ড্রোম নিয়ে ভর্তি হচ্ছেন ডেঙ্গু রোগী। ফলে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহতার মধ্যেও নেই কাঙ্ক্ষিত সচেতনতা।
চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এখন জ্বর ও শরীর ব্যথা হলেই সেটাকে করোনা ভেবে টেস্ট করতে যান। করোনা নেগেটিভ আসলেই ডেঙ্গু টেস্ট করতে যাচ্ছেন। ফলে ডেঙ্গু শনাক্ত হতে দেরি হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যেই সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর জটিল আকার ধারণ করছে। দেখা দিচ্ছে শক সিন্ড্রোম। এমন অবস্থা নিয়ে রোগীরা হাসপাতালে আসলে বাঁচানো কঠিন হয় যায়।
রাজধানীর শিশু হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বর্তমানে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে ৬৮ শিশু জন। যাদের মধ্যে আইসিইউ’তে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জীবন-মৃত্যুর সাথে লড়ছে ৮ জন। শক সিন্ড্রোম নিয়ে হাসপাতালে এলে তাদের অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে থাকে তাই আইসিইউ প্রয়োজন হয় বলে জানান কর্তব্যরত নার্সরা।
গত সাত দিনে হাসপাতালটিতে ৮৪ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৬ জন চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগী এই হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেছে।
হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে পুরুষ ওয়ার্ডে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন ১৬ বছর বয়সী আসাদ চৌধুরী। জ্বর ও শরীর ব্যথা অনুভুত হওয়ায় প্রথমে করোনা টেস্ট করিয়েছিলেন। নেগেটিভ আসার পরে ডেঙ্গু টেস্ট করানো হয়। ডেঙ্গু রেজাল্ট পজিটিভ এলে গত রোববার হাসপাতালে ভর্তি হন।
আসাদের মা লাভলী চৌধুরী বলেন, প্রথমে জ্বর, শরীর ব্যথা ও বমির কারণে খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছিলো। প্রথমে নর্মাল ডাক্তার দেখানো ও কোভিট টেস্ট করানো হয়। সেগুলোতে কিছু ধরা না পড়লে ডেঙ্গু টেস্ট করানো হয়। তারপর তিন হাসপাতাল ঘুরে বেড না পেয়ে এখানে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছি। ওর শরীর প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে যাওয়ায় কথাই বলত পারে না জোরে। শরীরে প্লাটিলেট মাত্র ত্রিশ হাজার। ডাক্তাররা বলছেন, অনেক লেট হয়ে গেছে। তাই খুব দুশ্চিন্তায় আছি।
একই হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে আট দিন থেকে চিকিৎসাধীন আছেন ৮ বছর বয়সী শিশু আকসা।
এখন অবস্থা কিছুটা ভালো হলেও গতকাল পর্যন্ত বেশ দুশ্চিন্তা ছিলো উল্লেখ করে তার বাবা নূর ইসলাম চৌধুরী বলেন, হুট করে জ্বর দেখা দেওয়ায় আমরা প্রথমে করোনা ভেবেছিলাম। তবে করোনা ও ডেঙ্গু দুইটাই টেস্ট করানো হয়। ডেঙ্গু পজিটিভ হলে এখানে এনে ভর্তি করাই। শুক্রবারে জ্বর নেমে যায়। তারপর থেকে দ্রুত গতিতে প্লাটিলেট কমতে থাকে। প্লাটিলেট কমতে কমতে ৪০ হাজারে নেমে এসেছিলো। এখন এক লাখের উপরে প্লাটিলেট আছে তাই কিছুটা স্বস্তি অনুভব করছি।
হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের উপ-পরিচালক (অ্যাডমিন এ্যান্ড লজিস্টিক) প্রফেসর ডা. আনিসুজ্জামান বলেন, যেসব ডেঙ্গু রোগী সময়মতো ডেঙ্গু শনাক্ত করতে পারছেন না তারা শক সিন্ড্রোম নিয়ে হাসপাতালে আসেন। শক সিন্ড্রোমের রোগীদের বাহির থেকে সতেজ বা ভালো দেখা গেলেও ভেতরে ভেতরে তারা অনেক আগেই শেষ হয়ে যায়। এই সময়ে রোগীর শরীরে প্লাটিলেট কমতে থাকে, ব্লাডসেলগুলো ভেঙে রক্ত পানি হয়ে যায়। এমন অবস্থা হওয়ার পরে হাসপাতালে রোগী নিয়ে আসলে বেশি কিছু করার থাকে না।
তিনি বলেন, হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে একজন বয়স্ক নারী এবং অন্যরা জটিল রোগে আক্রান্ত ছিলেন।
এই চিকিৎসক আরো বলেন, রিভার্সিবল ও ইরিভার্সিবল দুই ধরণের শক আছে। রিভার্সিবল শকে আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগীদের যথাযথ চিকিৎসা দিলে আরোগ্য হয়। আবার রিভার্সিবল রোগী যদি একটা নির্দিষ্ট লেভেল অতিক্রম করে ফেলে তখন সেটা ইরিভার্সিবল হয়ে যায়। এই অবস্থায় রোগীর ব্রেইন, লিভার আর কিডিনি কোনটাই কাজ করে না। এই রকম অবস্থা হলে রোগীর আশা ছেড়ে দেওয়া হয়।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এমন উদ্বেগজনকহারে মৃত্যুর কারণ হিসেবে অসচেতনতার কথা বলছেন চিকিৎসকরা। এছাড়াও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ডেঙ্গুতে মৃত্যু বাড়ার পেছনে ‘করোনার কারণে ডেঙ্গুকে অবহেলা’ করার কথা বলছেন জোর দিয়েই।
এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু হার বাড়ার কারণ কী? এমন প্রশ্নের জবাবে গণস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন বলেন, সাধারণত মহামারির পরের বছর ডেঙ্গুর মতো ডিজিসগুলো কম হয়। সে হিসেবে গতবছর কম ছিলো এবং এবার বেশি। এবার ডেঙ্গু রোগী করোনার কারণে অবহেলার শিকার হচ্ছেন। জ্বর, শরীর ব্যথা হলেই সবাই করোনা মনে করে টেস্টের জন্য যাচ্ছেন। যখন করোনা নেগেটিভ আসে, জ্বর সারে না তখন ডাক্তারের কাছে যায়। ডাক্তার ডেঙ্গুর টেস্ট দেয় সেই রিপোর্ট পেয়ে চিকিৎসা করাতে করাতে পাঁচ ছয় দিন দেরি হয়ে যায়। ফলে মৃত্যুর হার বেড়েছে।
উল্লেখ্য, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গতকাল বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩০৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছর একদিনে এই দ্বিতীয়বারের মতো ৩০০ জনের বেশি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেন।
একই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও চার জনের মৃত্যু হয়েছে। এ পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণে ৩০ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে জুলাই মাসে ১২ জন ও আগস্টে ১৮ জন মারা গেছেন।