নিজস্ব প্রতিবেদক:
বিভাগীয় শহর বরিশাল থেকে নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ইতিহাস ঐতিহ্য ভিত্তিক ম্যাগাজিন ‘মুক্তবুলি’। ইতোমধ্যে এর ২০টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। ‘পাঠক যারা, লেখক তারা’ এই শ্লোগান নিয়ে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাস থেকে যাত্রা শুরু করে ম্যাগাজিনটি। পর্যায়ক্রমে ম্যাগাজিনটি বরিশাল অঞ্চলের পাঠকদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। দ্বি-মাসিক এ ম্যাগাজিনটি পরিচিত লেখকদের পাশাপাশি নবীন লেখকদের লেখা প্রকাশ করে বেশ কিছু নতুন লেখক তৈরির কাজ করছে সুনিপুনভাবে। তাছাড়া নান্দনিক ডিজাইন, গেটআপ- মেকআপ ও ঝকঝকে ছাপার কারণে মুক্তবুলি ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
মুক্তবুলি প্রথম সংখ্যায় সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ন প্রবন্ধ ও নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়েছে। এরমধ্যে বাংলার বুলবুল আব্বাস উদ্দীন আহমদের বরিশাল সফর নিয়ে চমৎকার একটি প্রবন্ধ লিখেছেন গবেষক মাহমুদ ইউসুফ। ওই প্রবন্ধের মাধ্যমে বরিশালের নবীন পাঠকরা জানতে পারেন- অভিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা একে ফজলুল হক কতটা ভালোবাসতেন শিল্পীদের। সুর সম্রাট আব্বাসউদ্দীন আহমদকে স্টিমার থেকে রিসিভ করার জন্য কয়েকঘন্টা হুলারহাট বন্দরে অবস্থান করেছিলেন অভিভক্ত বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা একে ফজলুল হক। এছাড়া সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক কার্যক্রমের বেশ কিছু আলোকচিত্র ছাপা হয়েছে মুক্তবুলি প্রথম সংখ্যায়। সবমিলিয়ে দারুন ছিল সংখ্যাটি।
দ্বিতীয় সংখ্যায় আলোচিত হয়েছিল ‘ভাষা আন্দোলনে বরিশাল’ শীর্ষক গবেষণাধর্মী একটি প্রবন্ধ। এছাড়াও তথ্যবহুল বেশ কিছু প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে ওই সংখ্যায়।
তৃতীয় সংখ্যায় রমযান বিষয়ক লেখা প্রধান্য দিয়ে অন্যান্য বিষয়েও আর্টিকেল ছাপা হয়েছে। চতুর্থ সংখ্যায় বরিশালের ঐতিহ্যবাহী বিবির পুকুর নিয়ে প্রচ্ছদ রচনা ছাপা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে নবম সেক্টরের কমান্ডার মেজর এমএ জলিলকে নিয়ে বেশকিছু গবেষণাধর্মী লেখা ছাপা হয়েছে মুক্তবুলি পঞ্চম সংখ্যায়। ষষ্ঠ সংখ্যায় সাগরকন্যা কুয়াকাটাকে নিয়ে তথ্যবহুল একটি লেখা সহ বরিশালের অনেক অজানা বিষয় পাঠকের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। সপ্তম সংখ্যায় বাংলা নববর্ষকে তুলে ধরা হয়েছে নতুন ব্যঞ্জনায়। এই সংখ্যায়- বাঙালিয়ানার নামে পয়লা বৈশাখের এই দিনে আমরা কি ধরণের অপসংস্কৃতি আর শিরকে মেতে উঠি তা চোখে অঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন লেখকরা।
অষ্টম সংখ্যায় ‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল কেন অপরিহার্য’ এ বিষয়ে একটি গবেষণাধর্মী লেখা ছাপা হয়েছে। এছাড়াও সরকারি বিএম কলেজ বাংলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর জাহান আরা বেগমের ‘বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ঈদ-উল-ফিতর’ শীর্ষক ইতিহাস ভিত্তিক প্রবন্ধটি এই সংখ্যার মান অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
নবম সংখ্যায় বাংলা ষড়ঋতুর অন্যতম বর্ষাকালকে নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। বাংলা কবিতায় বর্ষা, বাংলা গানে বর্ষা সহ বর্ষাকাল নিয়ে বেশ কিছু ছড়া ও কবিতা ছাপা হয়েছে।
দশম সংখ্যায় বরিশাল বিভাগের ৬ টি জেলা ও বিভিন্ন উপজেলার নামকরণ বিষয়ে ইতিহাসের ধারায় আলোকপাত করা হয়েছে। এসব নামকরণের অনেক কিছুই ছিলো তরুন প্রজন্মের কাছে অজানা।
এগারতম সংখ্যায় বরিশাল বিভাগের নদ-নদী বিষয়ে প্রচ্ছদ রচনা ছাপা হয়েছে। এই প্রচ্ছদ রচনা লিখতে ১৫টি বই ও পত্রপত্রিকার রেফারেন্স ব্যবহার করেছেন লেখক। বারোতম সংখ্যায় দক্ষিণাঞ্চল তথা বরিশাল বিভাগের পর্যটন স্পট নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। এ সংখ্যায় বরিশালের ঐতিহাসিক দুর্গা সাগর নিয়ে প্রচ্ছদ রচনা লিখেছেন সাংবাদিক জাকিরুল আহসান।
তেরোতম সংখ্যায় বরিশাল অঞ্চলের সাদা মনের মানুষদের নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও যুগে যুগে বরিশালে বইমেলার ইতিহাস তুলে ধরেছেন লেখক ও গবেষক বেগম ফয়জুন নাহার শেলী।
চৌদ্দতম সংখ্যায় প্রচ্ছদ রচনার বিষয় ছিলো ‘ফেসবুক’। এই সংখ্যায় ফেসবুকের ইতিহাস ও বিভিন্ন ধরণের মৌলিক লেখা ছাপা হয়েছে।
পনেরোতম সংখ্যায় কভার স্টোরি ছিলো ‘বইয়ের সাতকাহন’। এই সংখ্যায় অধিকাংশ লেখক বই নিয়ে লিখেছেন অনেক বিশ্লেষণধর্মী লেখা। উঠে এসেছে বই পড়ার গুরুত্বের বিষয়টিও।
ষোলতম সংখ্যায় আলোকপাত করা হয়েছে ‘উদ্যোক্তা’দের নিয়ে। উদ্যোক্তারা কিভাবে তিলে তিলে গড়ে তোলেন নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কর্মসংস্থান হয় শত মানুষের। সেই সব স্বপ্নের কথা উঠে এসেছে মুক্তবুলির এই সংখ্যার পাতায় পাতায়।
সতেরোতম সংখ্যা প্রচ্ছদ রচনার বিষয় ছিলো- ‘জেলে জীবন’। জেলেদের জীবনের নানা দিক তুলে ধরার পাশাপাশি এখানে উঠে এসেছে জেলেদের জীবন নিয়ে রচিত সাহিত্যের বিষয়টিও।
আঠারোতম সংখ্যার বিষয় ছিলো আমাদের হারানো ঐতিহ্য ‘চিঠি’। চিঠি নিয়ে মানুষের ভালোবাসা, আবেগ, সাহিত্য সবকিছুই উঠে এসেছে এই সংখ্যায়। তথ্যপ্রযুক্তির প্রভাবে বর্তমান প্রজন্ম ভুলতে বসেছে চিঠি লেখার সেই আবেগ। তাও নানা ব্যঞ্জনায় তুলে ধরেছেন মুক্তবুলির লেখকরা।
উনিশতম সংখ্যার বিষয় ছিলো ‘শীত’। মানুষের মন ও মননে শীত ঋতুর প্রভাব, শীত নিয়ে রচিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড অনেক কিছুই উঠে এসেছে এই সংখ্যায়।
২০তম এই সংখ্যায় ‘প্রতিষ্ঠার ৪ বছর’ বিষয়ে মুক্তবুলির নানা অর্জন, অনেকের নতুন লেখক হয়ে ওঠাসহ স্মৃতিচারণমূলক একাধিক লেখা ছাপা হয়েছে।
এমনিভাবে মুক্তবুলির প্রতিটি সংখ্যা হয়ে উঠছে বিষয় ভিত্তিক বিভিন্ন বিষয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অনন্য দলিল। তবে বিষয় ভিত্তিক সংখ্যা প্রকাশ করা হলেও এখানে সবধরণের লেখা প্রকাশের সুযোগ রয়েছে। পুরো ম্যাগাজিনের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ লেখা থাকে বিষয় ভিত্তিক। বাকি ২০ থেকে ৩০ ভাগ লেখা থাকে যে কোন বিষয়ের। এজন্য নির্ধারিত বিষয়ের বাইরেও লেখকরা স্বাধীনভাবে যেকোন লেখা লিখতে পারেন মুক্তবুলির পাতায়। তাছাড়া মুক্তবুলি ওয়েবসাইটেও নিয়মিত মৌলিক লেখা প্রকাশের সুযোগ রয়েছে।
মুক্তবুলির সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে এই ম্যাগাজিনটি জাতির সামনে নিজেদের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এর লেখকরা যাই লিখছেন প্রতিটি লেখার সাথে রেফারেন্স ব্যবহার করছেন। যার কারণে লেখকরা কোন বিতর্কে জড়াচ্ছেন না। বর্তমান প্রজন্মকে তাদের প্রকৃত ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন করাই মুক্তবুলি ম্যাগাজিন প্রকাশের মূল উদ্দেশ্য।
মুক্তবুলি ম্যাগাজিনের প্রকাশক ও সম্পাদক আযাদ আলাউদ্দীন বলেন, সিনিয়র লেখকদের পাশাপাশি আমরা এই ম্যাগাজিনে নবীন লেখকদেরও যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করি। কারণ এইসব নবীন লেখকদের মধ্য থেকেও একসময় ভালোমানের বিখ্যাত লেখক বেরিয়ে আসতে পারে। সবমিলিয়ে আমরা একটি শক্তিশালী লেখক বলয় তৈরি করছি। এই ম্যাগাজিনে লেখার জন্য কোন বিধিনিষেধ নেই। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টানসহ যে কোন ধর্মের নারী-পুরুষ সবাই এখানে মন খুলে লিখতে পারেন এবং লেখা পাঠাতে পারেন। কারণ এই ম্যাগাজিনটির নামইতো হচ্ছে ‘মুক্তবুলি’। এর শ্লোগান হচ্ছে ‘পাঠক যারা, লেখক তারা’। তবে এই ম্যাগাজিনে ইতিহাস-ঐতিহ্য ভিত্তিক কোন লেখা লিখতে হলে লেখককে অবশ্যই রেফারেন্স বা সূত্র উল্লেখ করে লিখতে হবে। মনগড়া কোন তথ্য এখানে তুলে ধরার সুযোগ নেই। তিনি আরো বলেন, আমরা ইতোমধ্যে মৌলিক লেখার জন্য মুক্তবুলির লেখকদের সম্মানী প্রদান করার রীতি চালু করেছি। তাছাড়া ভবিষ্যতে এই ম্যাগাজিনের খরচ বাদে যা আয় হবে তার পুরোটাই লেখক সম্মানী ও লেখকদের কল্যাণে ব্যয় করা হবে।