নিউজ ডেস্ক:
আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ থেকে সরে এসেছে সরকার। প্রকল্পটি কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলায় নির্মাণের কথা ছিল। এ লক্ষ্যে ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন, পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) এবং সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রক্রিয়া শুরু হয়। একাধিকবার মেয়াদ বাড়ানোর পর তা বন্ধ ঘোষণার জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানায় বিদ্যুৎ বিভাগ।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে কাজ অসমাপ্ত রেখে প্রকল্পটির ‘সমাপ্ত’ অনুমোদন করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। অনুমোদনের পর সম্প্রতি তা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অভিহিত করা হয়।
সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বলছেন, কয়লা, গ্যাস, তেল– ফসিল জাতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ধীরে ধীরে সরে নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে মনোযোগ রয়েছে সরকারের। বিশ্বের বিভিন্ন দেশই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ থেকে সরে আসছে। এমন পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে মনোযোগ দেয়ার বিষয়টিকে স্বাগত জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ থেকে সরে আসার কারণ হিসেবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, প্রকল্প এলাকার নিকটবর্তী স্থানে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। কাজেই ওই এলাকায় আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা সম্ভব নয় এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বাস্তবতার নিরিখে কাজ অসমাপ্ত রেখে প্রকল্পটি এ পর্যায়েই সমাপ্ত ঘোষণার প্রয়োজন।
প্রকল্পটির নাম ছিল ‘ইজিসিবি লিমিটেডের আওতায় কক্সবাজার জেলার পেকুয়ায় ২x৬০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন, ইআইএ ও সম্ভাব্যতা যাচাই’। বিদ্যুৎ বিভাগের আওতায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছিল ইস্টার্ন গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশ (ইজিসিবি) লিমিটেড। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫১৫ কোটি ৮৫ লাখ ৫২ হাজার টাকা। এর মধ্যে সরকারের ছিল ৪৯৯ কোটি ৪৬ হাজার এবং ১৬ কোটি ৮৫ লাখ ছয় হাজার ছিল সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন। এর বড় একটা অংশই ব্যয় হয়েছে। তবে সেটার পরিমাণ জানা সম্ভব হয়নি।
বিদ্যুতের বিষয়ে সরকারের চিন্তা জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘সরকার চাচ্ছে নবায়নযোগ্যে বিদ্যুতের দিকে যেতে। কিন্তু হঠাৎ করে তা পারবে না। ধরুন, আমরা উড়োজাহাজে চলছি, সেটাতে ত্রুটি আছে, কিন্তু থামাবার উপায় নেই। উড়োজাহাজ চলবে, ত্রুটিও মেরামত করতে হবে।’
‘কয়লা তো প্রথম শত্রু। এরপর অন্যান্য শত্রুও আছে, যেমন- গ্যাস, তেল। এগুলো থেকেও সরে যেতে হবে। সৌর, বাতাস, ভূগর্ভে যদি থাকে- সেগুলোতে যেতে হবে আমাদের’- মন্তব্য পরিকল্পনামন্ত্রীর।
এম এ মান্নান বলেন, ‘নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ধীরে ধীরে বাড়বে, আর অন্যগুলো অতটা বাড়বে না। তারপর এটা শেষ হয়ে যাবে। ২০৫০ সাল নাগাদ আমরা আশা করি, আমাদের পণ্ডিতরাও বলেন, নবায়নযোগ্য-তে যেতে পারব।’
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শক্তি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ড. এস এম নাসিফ শামসের সঙ্গে। তিনি নবায়নযোগ্য শক্তি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরেছেন। বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রচুর নদী আছে, আমাদের আবহাওয়া প্রচণ্ড রকমে কৃষিবান্ধব। আমাদের বালি জমিতেও ফসল ফলে। কাজেই শুধু অকৃষি জমিতে যে সৌরবিদ্যুৎ করা যাবে, এ ধারণা থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। কারণ, এক মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সাড়ে তিন একর জমি লাগে। ধরে নেই, ৫০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। সেক্ষেত্রে ১৫০ একরের বেশি জমি লাগবে। অর্থাৎ অনেক জমির প্রয়োজন হয় সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে।’
বিষয়টির সমাধান দিয়ে নাসিফ শামস বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি নির্দেশনা রয়েছে যে, কৃষি ও সৌর– দুটোকেই একসঙ্গে করতে হবে। এ ব্যাপারে আমি ব্যক্তিগতভাবে জোর দিতে চাই। কৃষির যে নতুন নতুন ধারা, সৌরবিদ্যুতের সঙ্গে মাছ চাষকে যুক্ত করতে পারি। পঞ্চগড়ে একটি প্রতিষ্ঠান সৌরবিদ্যুতের সঙ্গে পোল্ট্রি ফার্ম করছে। আমাদের মাটিকে ব্যবহারযোগ্য রেখে সৌরবিদ্যুৎ বা নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে হাত দিতে হবে।’
সরকার অনেক বড় বড় সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প সই করলেও সেগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলেও জানান শক্তি ইনস্টিটিউটের এ শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘উদ্যোক্তা যারা আছেন, তাদের একসঙ্গে নিয়ে সরকারকে দেখতে হবে যে, তারা কেন পারছেন না? সেগুলোর ট্যারিফ রেটও অনেক ভালো ছিল। এখন সৌরবিদ্যুতের যে চুক্তিগুলো হচ্ছে, সেগুলো অনেক কমে হচ্ছে। আমার কথা হলো, বেশি রেট নিয়ে তারা কেন সফল হলো না? বিষয়টা আগে বের করা দরকার।’
‘ব্যবসায়ীদের সহায়তা করতে হবে। তা না হলে প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগই মুখ থুবড়ে পড়বে’- যোগ করেন তিনি।
নাসিফ শামসের মতে, প্রকৃতিতে যে বিদ্যুৎ আছে, সেটা পরিবেশবান্ধব। প্রচলিত বিদ্যুৎকেও ধরে রাখতে হবে। না হলে সেটা টেকসই হবে না। বিদ্যুতের সমস্যা একদম না দেখতে চাইলে গ্যাস, কয়লা, সৌর, বাতাস– সবকিছু নিয়ে ভাবতে হবে।
তবে ‘নবায়নযোগ্য জ্বালানিতেই ভবিষ্যৎ’ বলে মনে করেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী। তার যুক্তি, ‘ফসিল তো এখন ধ্বংসের ব্যাপার। ফলে কত দ্রুত এটা বন্ধ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যাওয়া যায়, সেদিকেই আমাদের চোখ রাখা দরকার। আমাদের পরিকল্পনাটা সেরকমই হওয়া উচিত।’
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির অন্যতম এ নেতা বলেন, ‘সারা দুনিয়া-ই নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে যাচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য বড় ধরনের আন্দোলন শুরু হয়েছে। ইউরোপ থেকে শুরু করে চীন, ভারতের মতো তুলনামূলক নবীন দেশও তাদের বিদ্যুতের বড় একটা অংশ নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে উৎপাদন করছে। নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে তাদের হার বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। এগুলো একটা বৈশ্বিক প্রবণতা। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশেও ২০৫০ সাল অব্দি বিদ্যুতের যে চাহিদা তৈরি হবে, তার অন্তত অর্ধেক নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আসা সম্ভব। সেটা বৈজ্ঞানিকভাবেই সম্ভব।’
ইতোমধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তির নানা ধরনের বিকাশ সারা বিশ্বজুড়ে ঘটে যাচ্ছে, সেগুলো বাংলাদেশকেও ব্যবহার করতে হবে বলে মনে করেন জোনায়েদ সাকী।
তিনি বলেন, ‘কৃষি উৎপাদনও হবে পাশাপাশি সৌরবিদ্যুৎও তৈরি হবে- এমন নতুন প্রযুক্তি চলে এসেছে। ফলে এটা একটা বিকাশমান খাত। এ বিকাশমান খাতে প্রতিদিনই নতুন নতুন ডেভেলপমেন্ট (উন্নয়ন) হবে। এটা সম্পর্কে আজ কোনো চূড়ান্ত কথা বলা যাবে না। শুধু এটুকু বলা যাবে, নবায়নযোগ্য জ্বালানিই ভবিষ্যৎ। আর ফসিলের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে।’