নিজস্ব প্রতিবেদক:
সৌদি আরবে বাংলাদেশি নারীকর্মীদের ওপর বর্বর নির্যাতনের ঘটনায় সরকারের ভেতরে ও বাইরে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশটিতে নারীদের পাঠানো নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছে সরকার।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশটিতে এখনই নারীকর্মী পাঠানো বন্ধ না করে এর প্রতিকার খুঁজে বের করা উচিত। কর্তৃপক্ষ বলছে, এ বিষয়ে দেশটির সঙ্গে আলোচনা চলছে।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার বাংলাদেশি সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন। অপর এক তথ্য বলছে, শুধু সেপ্টেম্বর মাসে সৌদি আরব থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরেছেন সহস্রাধিক নারী শ্রমিক। এদের অনেকে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথাও জানিয়েছেন। দেশে আসার সময় প্রাপ্য বেতনও তাদের দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
নারীকর্মী নির্যাতনের বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা নির্যাতিত হওয়ার জন্য কোনো কর্মী পাঠাই না। একজন নারীকর্মীও যদি বিদেশে নির্যাতনের শিকার হন সেটা আমাদের জন্য সুখকর নয়।’
তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে সৌদি সরকারের সঙ্গে আমরা আলোচনা চালাচ্ছি। ইতোমধ্যে ঢাকায় দেশটির চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে ডেকে এ বিষয়ে জানিয়েছি। তিনি বিষয়টি নিয়ে তার দেশের সঙ্গে কথা বলার আশ্বাস দিয়েছেন।’
‘এছাড়া আগামী ২৬ ও ২৭ নভেম্বর দুদেশের যৌথ টেকনিক্যাল কমিটির বৈঠক রয়েছে। সেখানেও এ বিষয়ে আলোচনা হবে’- বলেন ইমরান আহমদ।
তিনি এমনও বলেন, সৌদি আরবে নারী শ্রমিক নির্যাতন রোধে সব ধরনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। তবে নারীকর্মীদের নির্যাতনের বিষয়ে সৌদি আরবের আইনে হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধনে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
তবে অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নারীকর্মী বিদেশে না পাঠানো কোনো সমাধান নয়। তবে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে পাঠাতে হবে। এছাড়া গৃহকর্মী হিসেবে না পাঠিয়ে অন্য সেক্টরের দক্ষ কর্মী হিসেবে পাঠানোর পক্ষে মত দেন তারা।
এ বিষয়ে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) সিনিয়র গবেষক ড. জালাল উদ্দিন সিকদার বলেন, ‘নারীকর্মী বিদেশে না পাঠানোর কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না। অনেক বাংলাদেশি নারীই বিদেশে গিয়ে সফল হচ্ছেন। দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। সংসারের উন্নতিতে ভূমিকা রাখছেন। হঠাৎ করে নারীকর্মী না পাঠানোর সিদ্ধান্ত হলে তাদের সঙ্গে তো অন্যায় করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্য, তাইওয়ান, হংকংয়ে বাংলাদেশের অদক্ষ নারীকর্মীদের চাহিদা রয়েছে। আমাদের উচিত নির্যাতনের ঘটনাগুলো তদন্ত করে চিহ্নিত করা।’
ড. জালাল বলেন, ‘একটা নারীও যদি নির্যাতিত হয়, এর দায় রাষ্ট্রকে নিতে হবে। তবে সমস্যাটার মূল খুঁজে বের করতে হবে। প্রথম ভুল ছিল, কূটনৈতিক দর কষাকষির ক্ষেত্রে আমরা শক্ত থাকতে পারিনি। নারীদের সুরক্ষার বিষয়ে যেসব শর্ত রাখা উচিত ছিল, সেখানে শক্ত ভূমিকা নিতে পারিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন নারীকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দেয়ায় বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে সৌদি আরব। তখন আলোচনার জন্য আমরা ভালো অবস্থানে ছিলাম। তারপরও কর্মীদের সুরক্ষার অধিকারকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। যার ফল এখন পোহাচ্ছি।’
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘আমরা নারীদের বিদেশে পাঠানোর বিপক্ষে নই। তবে গৃহকর্মী হিসেবে নয়, নার্স বা কেয়ারগিভার, পোশাক শ্রমিকের মতো পেশায় দক্ষ করে তাদের পাঠাতে হবে। দক্ষ কর্মী পাঠানোর কোনো বিকল্প নেই।’
তার মতে, ‘বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। অথচ আমরা এখনও গৃহকর্মী হিসেবে মেয়েদের পাঠাচ্ছি। এটা দেশের জন্য সম্মানজনক নয়।’
শরিফুল হাসান বলেন, ‘সৌদি আরবে আমরা তখনই কোনো কর্মী পাঠাব যখন দেশটি তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। নিপীড়নের প্রতিটা ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি সৌদি আরবকেই নিশ্চিত করতে হবে।’
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সাল থেকে সৌদি আরবে বাংলাদেশ থেকে নারীকর্মী পাঠানো শুরু হয়। এখন পর্যন্ত দেশটিতে বাংলাদেশ থেকে প্রায় দুই লাখ ৭০ হাজার নারীকর্মী যান। তাদের মধ্যে ফিরেছেন প্রায় আট হাজার নারী। তারা প্রত্যেকেই নানাভাবে নিপীড়নের শিকার হয়ে দেশে ফেরেন বলে অভিযোগ ওঠে।
শুধুমাত্র সৌদি আরব থেকে লাশ হয়ে ফিরেছেন ৫৩ নারী। তাদের পরিবারের অভিযোগ, নির্যাতন সইতে না পেরে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। কারও কারও স্বজনের অভিযোগ, নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের মেরে ফেলা হয়েছে।
নারীরা সৌদি আরবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বলে বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দাবি করে আসলেও এ বিষয়ে সেভাবে মুখ খোলেনি সরকার। কিন্তু সম্প্রতি সৌদি ফেরত নারীদের ওপর করা সরকারের এক জরিপে এর ভয়াবহতার রূপ প্রকাশ পায়। পরে জাতীয় সংসদেও তিনজন সংসদ সদস্যের তোপের মুখে পড়েন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী।
প্রবাসী কল্যাণ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বিদেশে নারী নির্যাতন বন্ধে সরকার নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। সৌদি আরবে শেল্টার হোম নির্মাণ, সার্বক্ষণিক হটলাইন চালু, নারীদের নিকটাত্মীয়দের পাঠানো, ঠিকানাসহ ডাটাবেজ তৈরি, নির্যাতনের শিকার হলে অভিযোগ করা, দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে।
প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ জানান, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, নারীকর্মী পাঠানোর পূর্বে সংশ্লিষ্ট সৌদি রিক্রুটিং এজেন্সিকে সেখানকার বাংলাদেশের দূতাবাসে নিবন্ধন করতে হবে। কার বাসায় আমাদের কর্মীকে পাঠাচ্ছে সেটি জানাতে হবে। তাহলে সহজেই আমরা জানতে পারব কোন বাংলাদেশি নারী কোথায় আছেন। পাশাপাশি বিদেশ যাওয়ার পূর্বে নারীকর্মীদের নিবন্ধনেরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
‘আর কত শ্রমিক লাশ হয়ে ফিরলে সরকারের ঘুম ভাঙবে’- এমন প্রশ্ন রেখেছেন মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট সালমা আলী। তিনি বলেন, ‘আমরা তো বিদেশে নারীকর্মী পাঠানোর বিরোধিতা করছি না। মনে রাখতে হবে, নারীরা সেখানে ভিক্ষে করতে যায় না। শ্রম দিতে যায়। আমরা শুধু শ্রমের মর্যাদা চাইছি। এটি দুটি দেশের মধ্যকার বোঝাপড়ার ব্যাপার। বাংলাদেশ সরকার কেন সে দরকষাকষি করতে পারবে না।’
‘নারীরা সিঙ্গাপুর, হংকংয়ে গিয়ে শ্রম দিচ্ছে। সেখান থেকে তো এত অভিযোগ আসছে না। দক্ষরা যাচ্ছেন সেখানে। তারা মর্যাদা পাচ্ছেন। তারা যথাযথ আইনি সহায়তা পাচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘যাদের কাছে শ্রমিক যাচ্ছে, তাদের সঙ্গে যদি সমানে সমানে দাঁড়িয়ে দরকষাকষি করতে না পারি, তাহলে এ নির্যাতন হবেই। যদি নিজেদের অবস্থান শক্তভাবে উপস্থাপন করতে না পারি, তাহলে কোনোভাবেই এ ধরনের চুক্তি করা যাবে না। নির্যাতন হবে, যৌন নির্যাতন হবে, গর্ভবতী হবে, আত্মহত্যা করবে অথচ নারীরা সহায়তা পাওয়ার কোনো অধিকার রাখবে না, এ বর্বরতা তো কোনোভাবেই সহ্য করা যায় না।’
এজন্য সরকারকেই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে বলেও জানান তিনি।