ডেস্ক রিপোর্ট :
দেশব্যাপী ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি চক্রের ১৪ সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। চক্রটির মূলহোতা সেলিম ও উত্তম। তাদের নেতৃত্বে চক্রটির সদস্যরা প্রতিদিন ৫০০ টিকিট অনলাইন ও সরাসরি হাতিয়ে নিতেন। পরে সেগুলো তারা চড়া দামে বিক্রি করত। চক্রটির সদস্যরা প্রতিদিন ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে তা ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি করতেন। এই চক্রের সদস্যদের সঙ্গে কাউন্টারম্যান, ট্রেনের নিরাপত্তা কর্মীদের একটা বড় যোগসাজস রয়েছে। অনলাইনের টিকিট কারসাজি করে হাতিয়ে নিতে সহায়তা করতেন কাউন্টারম্যানরা।
আজ শুক্রবার (২৬ জানুয়ারি) রাজধানীর কারওয়ান বাজার মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। এর আগে বৃহস্পতিবার কমলাপুর ও বিমানবন্দর এলাকায় অভিযান চালিয়ে চক্রটির মূলহোতা উত্তম ও সেলিমসহ ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এমন সব তথ্য জানিয়েছে।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন দাবি করেন, এই চক্রের মূলহোতা সেলিম ও উত্তম। তাদের সাথে যারা এই কালোবাজারিতে জড়িত তাদের অনেকে কুলি, হকার ও বিভিন্ন পেশায় জড়িত। তবে তাদের কেউ কেউ ২৫ থেকে ৩০ বছর ধরে ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি করে সংসার চালাতেন। কারও নামে ছয় থেকে সাতটি পর্যন্ত মামলা রয়েছে। তারা বিভিন্ন সময়ে জেল খেটেছেন, কিন্তু জামিনে বের হয়ে আবারও একই কাজ করেন। ফলে ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি বন্ধ হয় না। চক্রটির সদস্যরা কাউন্টারম্যান, ট্রেনের নিরাপত্তা কর্মী ও স্টেশন কর্মীদের বেশ কিছু নাম জানিয়েছে। সেগুলো তারা যাচাই-বাছাই করছেন।
এ ঘটনায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন—চক্রের মূলহোতা সেলিম (৫০), আনোয়ার হোসেন ওরফে কাশেম (৬২), অবনী সরকার সুমন (৩৫), হারুন মিয়া (৬০), মান্নান (৫০), আনোয়ার হোসেন ওরফে ডাবলু (৫০), ফারুক (৬২), শহীদুল ইসলাম বাবু (২২), জুয়েল (২৩), আব্দুর রহিম (৩২), মূলহোতা উত্তম চন্দ্র দাস (৩০), মোর্শিদ মিয়া ওরফে জাকির (৪৫), আব্দুল আলী (২২) ও জোবায়ের (২৫)। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১ হাজার ২৪৪টি আসনের টিকিট, ১৪টি মোবাইল ফোন এবং টিকিট বিক্রয়ের নগদ ২০ হাজার টাকা জব্দ করা হয়।
যেভাবে হাতিয়ে নেওয়া হতো টিকিট
র্যাবের মঈন জানান, কমলাপুর রেলস্টেশনে সেলিম সিন্ডিকেটের মূলহোতা সেলিম এবং উত্তমের নেতৃত্বে চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে মহানগর প্রভাতী, তূর্ণা নিশিথা, চট্টলা এক্সপ্রেস, উপবন এক্সপ্রেস, মহানগর এক্সপ্রেস, পারাবত এক্সপ্রেস, উপকূল এক্সপ্রেস, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ও কালনী এক্সপ্রেসসহ বিভিন্ন ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি করে আসছিলেন। তাদের সহযোগীরা প্রথমত ট্রেনের কাউন্টারে বিভিন্ন ভ্রাম্যমান যাত্রী, রেলস্টেশনের কুলি, স্টেশনের আশপাশের এলাকার টোকাই, রিকশাওয়ালা ও দিনমজুরদের টাকার প্রলোভন দেখিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে দিতেন। পরে তারা তাদের কাছ থেকে টিকিটগুলো সংগ্রহ করতেন। এর বিনিময়ে প্রত্যেক কুলিকে তারা ৪টি করে টিকিটের বিপরীতে ১০০ টাকা করে দিতেন। এ ছাড়া কাউন্টারে থাকা কিছু অসাধু টিকিট বুকিং কর্মচারীদের দিয়ে বিভিন্ন সাধারণ যাত্রীদের টিকিট কাটার সময় দেওয়া এনআইডি সংগ্রহ করে রাখতেন। পরে সেগুলো ব্যবহার করে সংরক্ষণ করা প্রতিটি এনআইডি দিয়ে চারটি করে ট্রেনের টিকিট সংগ্রহ করতেন তারা। এভাবে তারা প্রতিদিন প্রায় পাঁচ শতাধিক টিকিট সংগ্রহ করতেন চক্রটি।
চক্রটির সদস্যরা র্যাবকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা টিকিট কাউন্টারে নিজেরা লাইনে দাঁড়াতেন। এরপর কৌশলে লাইনে অপেক্ষমান টিকিট প্রত্যাশী সাধারণ যাত্রীদের এনআইডি ব্যবহার করে চারটি টিকিট কিনে একটি যাত্রীকে দিয়ে বাকি তিনটি তারা কিনে নিতেন। এভাবেও তারা ঈদ, পূজা, সাপ্তাহিক ছুটিসহ বিশেষ ছুটির দিনগুলোতে টিকিট সংগ্রহ করতেন। তবে রেলস্টেশনে কর্মরত কিছু অসাধু কর্মচারী এবং অনলাইনে টিকিট বিক্রয়কারী ভেণ্ডর প্রতিষ্ঠান সহজ.কমের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও সার্ভার রুম বা আইটির সদস্যদের সহযোগিতায়ও টিকিট সংগ্রহ করতেন। এক্ষেত্রে তারা সার্ভারে সংরক্ষিত এনআইডির তথ্য ব্যবহার করে এমনকি সার্ভার ডাউন করে অনলাইনে টিকিট সংগ্রহ করতেন তারা। পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের দিয়ে অনলাইনে টিকিট কাটাতেন।
বিভিন্ন স্টেশনে থাকা তাদের সিন্ডিকেটের সদস্যরাও কাউন্টার থেকে স্ট্যান্ডিং টিকিট সংগ্রহ করতেন। এসব টিকিট সংগ্রহের পর বিক্রি হলে টিকিটের অতিরিক্ত মূল্য থেকে পাওয়া টাকা কাউন্টারের বুকিং কর্মচারীদের সঙ্গে ভাগভাগি করে নিতেন চক্রের সদস্যরা। ফলে ট্রেনের টিকিট প্রত্যাশীরা সার্ভারে ঢুকলে টিকিট পেতেন না।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানিয়েছে, তারা সেলিম ও উত্তমের নেতৃত্বে সময় বুঝে স্টেশনে অবস্থান করতেন। যারা রেলস্টেশনে এসে টিকিট পেতেন না এমন যাত্রীর কাছেই তারা চড়া দামে টিকিট বিক্রি করতেন। এ ছাড়া ট্রেন ছাড়ার সময় স্টেশনের আশপাশে থেকে তারা যাত্রীদের লক্ষ্য করতেন। যারা কাউন্টারে টিকিট পেতেন না তাদের কাছে গিয়ে টিকিট আছে বলে চড়া দাম চাইতেন ও ওই যাত্রী নিতে চাইলে তা বিক্রি করতেন। তারা প্রতিটি টিকিট তিন থেকে চার গুন বেশি দামে বিক্রি করতেন। পরে বিক্রিকৃত টিকিটের লভ্যাংশ তারা ৫০ শতাংশ ভাগ বাটোয়ারা করে নিতেন। বাকিটা স্টেশনের কাউন্টারম্যান, বুকিং কর্মচারী ও তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সহজ.ডট কমের কর্মচারী-কর্মকর্তা ও আইটি বিশেষজ্ঞদের দেওয়া হতো।
মঈন আরও জানান, গ্রেপ্তার সেলিম দীর্ঘ প্রায় ৩৫ বছর ধরে টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত। তিনি কমলাপুর রেলস্টেশনে ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি সেলিম সিন্ডিকেটের মূলহোতা। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় টিকিট কালোবাজারির অভিযোগে সাতটি মামলা রয়েছে। তিনি বিভিন্ন মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করেছেন। কিন্তু পরে জামিনে মুক্তি পেয়ে পুনরায় টিকিট কালোবাজারির কার্যক্রমে লিপ্ত হয়ে পড়েন।
অন্যদিকে গ্রেপ্তার উত্তম প্রায় ১৫ বছর ধরে ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত। তিনি বিমানবন্দর রেলস্টেশনের টিকিট কালোবাজারি চক্রের হোতা। তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় এই বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে স্টেশনে অবস্থান কবরতেন। তার বিরুদ্ধে টিকিট কালোবাজারির অভিযোগে চারটি মামলা রয়েছে। তিনিও বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করেছেন ও জামিনে মুক্তি পেয়ে পুনরায় টিকিট কালোবাজারির কাজে লিপ্ত হন।