ডেস্ক রিপোর্ট :
ইরান চুক্তিতে না এলে দেশটিতে সামরিক হস্তক্ষেপের হুমকি দিয়েছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু সাম্প্রতিক দিনগুলোতে তিনি কূটনৈতিক পথে হাঁটতে চান বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। ইরানের পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি নিয়ে গত সপ্তাহে ওমানে প্রথম দফা আলেচনার পর শনিবার ইতালিতে দ্বিতীয় দফা আলোচনায় বসতে যাচ্ছেন ইরান ও অ্যামেরিকার প্রতিনিধিরা।
এ আলোচনায় ইরানের পরমাণু সমৃদ্ধকরণ সীমিত করতে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে চান প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। এর আগে ইরান চুক্তিতে না এলে দেশটিতে সামরিক হস্তক্ষেপের হুমকি দেন ট্রাম্প। কিন্তু সাম্প্রতিক দিনগুলোতে তিনি কূটনৈতিক পথে হাঁটতে চান বলে সাংবাদিকদের জানান। সর্বশেষ শুক্রবার হোয়াইট হাউযের ওভাল অফিসে ট্রাম্প রিপোর্টারদের বলেন, ‘খুব সহজভাবে বলতে গেলে আমি ইরানের পরমাণু অস্ত্র অর্জন বন্ধ করতে চাই। তাদের কাছে পরমাণু অস্ত্র থাকতে পারবে না। ‘আমি চাই ইরান মহান, সমৃদ্ধ ও সমীহ জাগানিয়া (দেশ) হোক।’
ট্রাম্পের এ বক্তব্যে তেহরানের সঙ্গে ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক পথে হাঁটতে চাওয়ার ইচ্ছার প্রতিফলন দেখা গেছে। এমন বাস্তবাতয ইরানের পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় ও ঘটনা এক এক্সপ্লেইনারে তুলে ধরেছে রয়টার্স।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো কোথায়
দেশের বিভিন্ন স্থানে পরমাণু কর্মসূচি চালাচ্ছে ইরান। কয়েক দশক ধরে ইসলামী প্রজাতন্ত্রটির পরমাণু ক্ষেত্রগুলোতে ইযরায়েলি বিমান হামলার হুমকি থাকলেও মাত্র কয়েকটি ক্ষেত্র রয়েছে মাটির নিচে।
ইরানের কি পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর কর্মসূচি আছে
অ্যামেরিকা ও জাতিসংঘের পরমাণু শক্তিবিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি তথা আইএইএ মনে করে, ইরানের সমন্বিত, গোপন পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচি রয়েছে, যেটি ২০০৩ সালে স্থগিত করেছিল দেশটি। যদিও বিষয়টি বারবার অস্বীকার করে তেহরান বলেছে, এ ধরনের কর্মসূচি তাদের নেই এবং এ সংক্রান্ত পরিকল্পনাও নেই।
বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে ২০১৫ সালের এক চুক্তি অনুযায়ী পরমাণুবিষয়ক কর্মকাণ্ড সীমিত করার বিষয়ে সম্মত হয় ইরান। তবে ২০১৮ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প চুক্তি থেকে অ্যামেরিকাকে একতরফাভাবে সরিয়ে নিয়ে এলে এটি ভেস্তে যায়। পরের বছর ইরান পরমাণু সমৃদ্ধকরণে বিধিনিষেধ থেকে সরে আসে।
ইরান কি পরমাণু সমৃদ্ধকরণ বাড়াচ্ছে
বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে চুক্তি ভেঙে যাওয়ার পর থেকে পরমাণু সমৃদ্ধকরণ বাড়াচ্ছে ইরান। এর মাধ্যমে তথাকথিত ব্রেক আউট টাইম (একটি পরমাণু বোমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম হাতে পাওয়ার সময়) কমাচ্ছে তেহরান। উইপন্স-গ্রেড ইউরেনিয়াম তথা ডব্লিউজিইউ দিয়ে বোমা বানাতে অনেক সময় দরকার। এ সময়টা কত লম্বা, তা স্পষ্ট নয়। এটি একই সঙ্গে তর্কের বিষয়।
আইএইএর হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দুটি পরমাণু ক্ষেত্রে ইউরেনিয়ামকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করছে ইরান, যা অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ৯০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের কাছাকাছি। তাত্ত্বিক দিক থেকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ আরও বাড়ালে দেশটি ছয়টি পরমাণু বোমা তৈরি করতে পারবে।
কী ছিল ইরানের সঙ্গে বিশ্ব শক্তিগুলোর ২০১৫ সালের চুক্তিতে
ইরান পরমাণু অস্ত্রের পেছনে ছুটছে বলে সন্দেহ করেছিল অনেক দেশ। যদিও তেহরান তা অস্বীকার করে আসছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি ২০১৫ সালে বৃটেইন, জার্মানি, ফ্রান্স, অ্যামেরিকা, রাশিয়া এবং চায়নার সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছায়, যেটি পরিচিতি পায় জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) নামে। এ চুক্তির আওতায় পরমাণু সমৃদ্ধকরণ সীমিত করার বিনিময়ে ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় জাতিসংঘ, অ্যামেরিকা ও ইউরোপিয়ান দেশগুলো।
জাতিসংঘের সিকিউরিটি কাউন্সিল ২০১৫ সালের জুলাইয়ের এক প্রস্তাবে চুক্তিটিকে অন্তর্ভুক্ত করে।
পরমাণু চুক্তির বিষয়ে অ্যামেরিকার ভূমিকা কী
নিজের প্রথম মেয়াদে ‘এ যাবতকালের সবচেয়ে বাজে চুক্তি’ আখ্যা দিয়ে ২০১৮ সালে জেসিপিওএ থেকে সরে আসেন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড টাম্প। সে সময় তিনি তেহরানের ওপর ওয়াশিংন আরোপিত সব নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় চুক্তির আওতায় পরমাণু সংক্রান্ত নানা অঙ্গীকার থেকে সরে আসে ইরান।
এ নিয়ে ট্রাম্পের উত্তরসূরি জো বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে তেহরানের পরোক্ষ আলোচনা হলেও হয়নি কোনো অগ্রগতি। জেসিপিওএর শর্ত অনুযায়ী, নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহালকে পরমাণুবিষয়ক অঙ্গীকার মানা থেকে আংশিক বা পুরোপুরি আসার ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করবে ইরান। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ইরানের বিরুদ্ধে ‘সর্বোচ্চ চাপ’ দেওয়ার নীতিতে ফিরে যান ট্রাম্প। তিনি পরমাণুবিষয়ক চুক্তিতে রাজি থাকার কথা জানালেও ইরান তার কর্মসূচি না ছাড়লে সামরিক শক্তি ব্যবহারের হুমকি দেন।
কী করছে ইরান
জাতিসংঘের পরমাণুবিষয়ক সংস্থা আইএইএ বলেছে, ‘নাটকীয়ভাবে’ পরমাণু সমৃদ্ধকরণ বাড়াচ্ছে ইরান, যা ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বিশুদ্ধ। এটি অস্ত্র তৈরির পর্যায় ৯০ শতাংশের কাছাকাছি। পশ্চিমা দেশগুলোর ভাষ্য, বেসামরিক প্রয়োজনে এত উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের প্রয়োজন হয় না। বোমা তৈরির লক্ষ্য ছাড়া কোনো দেশই এ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেনি। এর বিপরীতে ইরান বলছে, শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের লক্ষ্যে পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
স্ন্যাপব্যাক (পূর্ববর্তী অবস্থা বা পরিস্থিতিতে দ্রুত ফিরে আসা) কী
২০১৫ সালের চুক্তিতে ‘স্ন্যাপব্যাক’ নামের একটি প্রক্রিয়া ছিল যার মাধ্যমে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করা যাবে। চুক্তি অনুযায়ী, অংশগ্রহণকারী দেশ ও পক্ষগুলো ইরানের ‘উল্লেখযোগ্য নিষ্ক্রিয়তা’র অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হলে ১৫ সদস্যের জাতিসংঘের সিকিউরিটি কাউন্সিল স্ন্যাপব্যাক ব্যবস্থার প্রয়োগ করবে।
প্রক্রিয়া শুরুর ৩০ দিনের মধ্যে সিকিউরিটি কাউন্সিলকে নিষেধাজ্ঞা থেকে ইরানকে নিষ্কৃতি সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে ভোটের আয়োজন করতে হবে। নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্ত থাকতে হলে ইরানকে ৯টি ভোট পাওয়ার পাশাপাশি অ্যামেরিকা, রাশিয়া, চায়না, বৃটেইন কিংবা ফ্রান্স ভেটো দেবে না, সেটি নিশ্চিত হতে হবে। প্রস্তাবটি গৃহীত না হলে এবং সিকিউরিটি কাউন্সিল অন্য কোনো ব্যবস্থা না নিলে ইরানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের সব নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল হবে।
জাতিসংঘে এর আগে কী করেছে অ্যামেরিকা
ট্রাম্প চুক্তি থেকে বেরিয়ে এলেও ২০২০ সালের আগস্টে অ্যামেরিকা বলেছে, এটি স্ন্যাপব্যাক প্রক্রিয়ার ট্রিগার চেপেছে। এর পেছনে দেশটির যুক্তি ছিল, ২০১৫ সালের চুক্তিতে অংশগ্রহণকারী হিসেবে তখনও ছিল তাদের নাম। যদিও চুক্তির অন্য পক্ষ ইরান, জার্মানি, ফ্রান্স, বৃটেইন, রাশিয়া এবং চায়না সিকিউরিটি কাউন্সিলকে জানায়, তারা যুক্তরাষ্ট্র্রের এ সিদ্ধান্তকে স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়নি স্ন্যাপব্যাক প্রক্রিয়া।
চুক্তিতে অংশগ্রহণকারী সবার স্ন্যাপব্যাক প্রক্রিয়া শুরুর ক্ষমতা ছিল। যদিও বাস্তবে এ বিষয়ে আগ্রহী শুধু জার্মানি, ফ্রান্স ও বৃটেইন।
বর্তমানে কী হচ্ছে
জাতিসংঘের ২০১৫ সালের প্রস্তাবের মেয়াদ ১৮ অক্টোবর শেষ হয়ে যাওয়ার পর স্ন্যাপব্যাক চালুর সুযোগও সমাপ্ত হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে ইরানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা দিতে জাতিসংঘে নিযুক্ত অ্যামেরিকার রাষ্ট্রদূতকে নির্দেশ দেন ট্রাম্প। অন্যদিকে বৃটেইন, ফ্রান্স ও জার্মানি সিকিউরিটি কাউন্সিলকে জানায়, তারা স্ন্যাপব্যাক শুরু করতে প্রস্তুত। ইরানের পরমাণু কর্মকাণ্ডের বিষয়ে আইএইএর কাছ থেকে ‘সমন্বিত’ প্রতিবেদন চেয়েছে দেশ তিনটি। এ প্রতিবেদন নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিকে আরও মজবুত ভিত্তি দিতে পারে।
পরমাণুবিষয়ক চুক্তি অনুযায়ী, প্রথমে এতে অংশগ্রহণকারী পক্ষগুলোকে একটি দ্বন্দ্ব নিরসন প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করতে হবে। বৃটেইন, ফ্রান্স ও জার্মানি ২০২০ সালের জানুয়ারিতে এ প্রক্রিয়ার আশ্রয় নেয়। কিন্তু তার বিপক্ষে অবস্থান নেয় রাশিয়া। সিকিউরিটি কাউন্সিলে স্ন্যাপব্যাক কৌশল নিয়ে এগোনোর আগে বৃটেইন, ফ্রান্স ও জার্মানি সম্ভবত এ বিষয়টি মাথায় রাখবে যে, সেপ্টেম্বরে কাউন্সিলের সভাপতি হতে যাচ্ছে রাশিয়া।
স্ন্যাপব্যাক কার্যকর হলে কী হতো
স্ন্যাপব্যাক কার্যকর হলে ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল নাগাদ সিকিউরিটি কাউন্সিল ইরানের বিষয়ে যেসব ব্যবস্থা নিয়েছিল, সেগুলো ফিরে আসত। এসবের মধ্যে রয়েছে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা, পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা ও অন্যান্য কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি স্থানান্তর ও কারিগরি সহায়তার ওপর নিষেধাজ্ঞা, বৈশ্বিকভাবে সম্পত্তি অবরুদ্ধকরণ এবং ইরানের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এবং ইরান এয়ার কার্গো ও ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান শিপিং লাইন কার্গোতে নিষিদ্ধ পণ্য তল্লাশির জন্য বিভিন্ন দেশকে অনুমোদন।