হার না মানা প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসকে পাত্তাই দিচ্ছেন না বরগুনার আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সংগ্রামী পাঁচ করোনা যোদ্ধা। জীবন বাজি রেখেই চলছে তাদের সংগ্রাম। পরিবার পরিজন যেন তাদের কাছে তুচ্ছ। অকুতোভয় এ পাঁচ যোদ্ধা গত দের মাস ধরেই চালিয়ে যাচ্ছেন প্রাণপণ লড়াই। গত দের মাসে একটি দিনও ফরসুত দেয়নি নিজেদেরকে। বিলিয়ে দিয়েছেন মেধা এবং শ্রম করোনা ভাইরাসের উপসর্গ রোগীর সেবা ও নমুনা সংগ্রহে। নিজের ও নিজের পরিবার পরিজনের কথা না ভেবেই সেবাকে মুল ব্রত ধরেই এগিয়েছেন তারা এবং সফলতাও পেয়েছেন।
হাসপাতাল সুত্রে জানাগেছে, প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ। প্রথম স্তরে যখন করোনা ভাইরাস বাংলাদেশে আঘাত হানে তখন আমতলীকে করোনা ভাইরাসের লেস মাত্র নেই। সেই সময় থেকেই সদা প্রস্তুত ছিলেন আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শংকর প্রসাদ অধিকারী, তার সহযোগী আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ শাহাদাত হোসেন ও মেডিকেল অফিসার ডাঃ এমদাদুল হক চৌধুরী, মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট (ল্যাব) মোঃ রিয়াজ হোসেন ও মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট (ইপিআই) মোঃ আবুল বাশার। যদিও এই পাঁচজনের কাজ ছিল টিমওয়ার্ক। কিন্তু দুধর্ষ সাহসীকতা ও ভয়কে পরাস্ত করেই এগিয়ে চলেছেন তারা। হার না মানা যেন তাদের সেবার অধ্যয়ে নেই।
৭ এপ্রিল আমতলী উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি প্রবীন রাজনীতিবীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা জিএম দেলওয়ার হোসেন করোনা উপসর্গ নিয়ে আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসেন। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শংকর প্রসাদ অধিকারী ও আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ এমদাদুল হক চৌধুরী তার শারীরিক অবস্থা দেখেন। কিন্তু দুভাগ্য তাকে দেখার দুইদিন পর ৯ এপ্রিল জিএম দেলওয়ার হোসেন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরন করেন।
যদিও মৃত্যুর দিন তিনি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন কিনা জানা যায়নি। মৃত্যুর একদিন পরে তিনি করোনা ভাইরাস আক্রান্তের নমুনা প্রতিবেদন আসেন। হুরুস্তুল পরে যায় পুরো আমতলীতে। বরগুনা জেলা প্রশাসক মোঃ মোস্তাইন বিল্লাহ আমতলী উপজেলাকে লকডাউন ঘোষনা করেন। তাৎক্ষনিক দুই চিকিৎসক শংকর প্রসাদ অধিকারী ও ডাঃ এমদাদুল হক চৌধুরী হোম কোয়ারেন্টাইনে যেতে হয়। হোম কোয়ারেন্টাইনে থেকে শুরু হয় তাদের মুল যুদ্ধ।
তাদের যুদ্ধে শামিল হয় মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট মোঃ রিয়াজ হোসেন এবং টিকাদান টেকনোলজিষ্ট মোঃ আবুল বাশার। ১১ এপ্রিল ও ১২ এপ্রিল দুই দিনে তারা প্রায়াত আওয়ামীলীগ নেতা জিএম দেলওয়ার হোসেনের পরিবার ও তার সংস্পর্শে আসা ৪০ জনের নমুনা সংগ্রহ করেন। এরপর থেকে গত সোমবার পর্যন্ত ১৮০ জনের নমুনা সংগ্রহ করেছেন তারা। নমুনা সংগ্রহ করতে তাদের ছুটে যেতে হয় রোগীর বাড়ীতে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা নমুনা সংগ্রহ করছেন।
এর মধ্যে আটজন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। একজন সুস্থ্য হয়ে বাড়ী ফিরেছেন এবং ছয়জন এখনো হোম আইসোলেশনে থেকে করোনাকে জয়ের লড়াইয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। উৎকন্ঠা ও উৎবেগ বেড়ে গেলেও তাদের কাজ থেমে থাকেনি। চালিয়ে যাচ্ছেন তারা অকুতোভয়ে। গত ৭ এপ্রিল থেকে এদের পরিবার পরিজন ও শিশু সন্তানরা তাদের কাছে তুচ্ছ। বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তাদের শিশু সন্তানরা। একই ঘরে বসবাস করলেও চিকিৎসক ও টেকনোলজিষ্ট বাবা এক কক্ষে আর স্ত্রী সন্তান অন্য কক্ষে। খাবারের টেবিলেও তাদের দেখা নেই। হাহুতাশ চলছে পরিবারের লোকজনের মধ্যে। কিন্তু কিছুতেই তারা দমছে না।
ইতিমধ্যে গত ২ মে কুকুয়া ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর গ্রামের ইটভাটার শ্রমিক হাবিবুর রহমান সুস্থ্য হয়ে আমতলী হাসপাতাল ছেড়েছেন। কিছুটা হলেও সফলতা পেয়েছেন তারা। আর বাড়ীর আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসা নেয়া ছয়জন তারাও কিছুটা সুস্থের দিকে। তাদের চিকিৎসা দেয়া ও নমুনা সংগ্রহ করেছেন এই করোনা যোদ্ধা টিম।
করোনা ভাইরাস জয়ী মোঃ হাবিবুর রহমান ভুইয়া বলেন, হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের অনেক সহযোগীতা পেয়েছি। তাদের সেবাই আমি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেছি।
একই পরিবারে তিনজন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত পরিবারের সদস্য মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, চিকিৎসকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাসায় এসে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি আরো বলেন, হাসপাতালের টেকনোলজিষ্টরা পরিবারের চার সদস্যের নমুনা সংগ্রহ করেছেন। হাসপাতালের চিকিৎসক ও ষ্টাফদের আন্তরিক সহযোগীতাই এখন সুস্থ্যের পথে।
প্রায়াত জিএম দেলওয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাউন্সিলর জিএম মুছা বলেন, আমার বাবার মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত আমতলী হাসপাতালের চিকিৎসক শংকর প্রসাদ অধিকারী, শাহাদাত হোসেন, এমদাদুল হক চৌধুরী ও এবিএম তানজিরুল ইসলাম আন্তরিকভাবে চিকিৎসা সেবা দিয়ে গেছেন।
আমতলী হাসপাতালের মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট (ইপিআই) মোঃ আবুল বাশার বলেন, বর্তমান অবস্থায় নমুনা সংগ্রহ করার কাজটি অত্যান্ত ঝুঁকির। মুখের ভিতর এবং নাকের ভিতরের নরম অংশ থেকে দুইভাবে লালা সংগ্রহ করতে হয়। লালা সংগ্রহ করতে গিয়ে নিজের জীবনের উপর অনেক ঝুঁকি এসে যায়। তিনি আরো বলেন, করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে অনবরত লালা সংগ্রহ করে যাচ্ছি। গত এক মাস হয়েছে নিজের পরিবারের থেকে আলাদা। একই ঘরে থেকেও আমি পরবাসী। নিজের সন্তানকেও আদর করতে পারি না। আদর থেকে বঞ্চিত হয়ে আমার সন্তান। এর চেয়ে আর কষ্ট কি হতে পারে? তারপর নিজের জীবন বাজি রেখে মানুষের সেবা করে যাচ্ছি।
আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শংকর প্রসাদ অধিকারী বলেন, সেবাই আমাদের মুল ব্রত। সেবাই মানষিকতা নিয়েই এই পেশায় এসেছি। যতই ভয় ও কষ্টের হোক করোনা যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যাব না। যতদিন বেচে আছি ততদিন করোনা যুদ্ধ চলবে। তিনি আরো বলেন, করোনা যুদ্ধে আমরা সফল। ইতিমধ্যে একজন সুস্থ্য হয়ে বাড়ী ফিরেছেন এবং বাকীরা সুস্থ্যের পথে। আশাকরি তারাও দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন। করোনা আক্রান্ত রোগীকে সুস্থ্য করে বাড়ী ফেরাতে পেরেছি এর চেয়ে আনন্দের আর কিছুই নেই।