আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
অনাবৃষ্টি, সুপেয় পানির সংকট, সমুদ্রের স্তর বেড়ে যাওয়া ও যুদ্ধ-বিগ্রহের মতো নানা সংকটের কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। কিন্তু এর শেষ আঘাত কী হতে পারে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, এতে মানুষের বিলুপ্তি ঘটতে পারে কিনা, তা নিয়ে গবেষণায় ঘাটতি রয়েছে। যদি পৃথিবী অতিমাত্রায় গরম হয়ে যায়, তাহলে শেষ পরিণতি কী ঘটবে, কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তন তার শেষ খেলা খেলবে—এ বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিপজ্জনকভাবে কম।
বিশ্বের শীর্ষ একদল বিজ্ঞানী বলছেন, মানুষের সম্ভাব্য বিলুপ্তি নিয়ে আমাদের অনেক বেশি ভাবতে হবে। এ নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা থাকতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের মহাবিপর্যয় প্রতিরোধে প্রস্তুতি নেয়ার সময় হয়েছে। বিবিসি, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট ও গার্ডিয়ান এমন খবর দিয়েছে।
বিজ্ঞানীরা এমনটি বলছেন না যে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ভয়াবহ আঘাতটি আসতে যাচ্ছে। অর্থাৎ মানব জাতির বিলুপ্তি ঘটবে, তা বলা হচ্ছে না। তাদের দাবি, সমস্যাটি হচ্ছে কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তন শেষ আঘাত হানবে কিংবা আদৌ এসব কিছু ঘটবে কিনা; তা কেউ জানেন না। কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণতায় মোকাবিলায় সেই হিসাব-নিকাশ করতে হবে।
অতিরিক্ত উষ্ণতায় সামাজিক বিপর্যয়, মানুষ বিলুপ্তি ঘটতে পারে কিংবা না-ও ঘটতে পারে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের শেষ আঘাত কী হতে পারে, তা নিয়ে নিখুঁত গবেষণা করতে হবে। বিজ্ঞানীরা সেই দাবিই করছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের শেষ আঘাত মোকাবিলায় বিশ্বকে এখনই প্রস্তুত হতে হবে বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা। বিজ্ঞানীরা বলেন, কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বর্তমান অনিশ্চয়তা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার ব্যবস্থা নিয়ে ভাবলে মহাবিপর্যয়ের শঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে এমন কিছু ঘটা অসম্ভবও না।
বিজ্ঞানীদের মতে, ভবিষ্যৎ বিরূপ পরিস্থিতি সম্পর্কে বেখবর থেকে ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা করতে চাওয়ার চেয়ে বোকামি আর কিছু হতে পারে না। বৈশ্বিক উষ্ণতায় মহাবিপর্যয় ঘটার যৌক্তিক কারণের অভাব নেই। কিন্তু সেই ঝুঁকি এড়ানোর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না-থেকে চলমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হতে পারে বিশ্বকে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের শেষ-ধাক্কার মোকাবিলায় এখনই প্রস্তুতি নেয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে সম্ভাব্য চরম পরিণতির বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করলে সঠিক পদক্ষেপ নেয়া, প্রতিরোধ সক্ষমতা বাড়ানো ও নীতিমালা গ্রহণ সহজতর হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পরমাণু যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে আশির দশকে বেশ কিছু গবেষণা চালানো হয়েছিল। ওই সব গবেষণায় যে ‘পারমাণবিক শীত’ তত্ত্বের কথা বলা হয়েছিল; তা থেকে জনমনে উদ্বেগ ও সেই সঙ্গে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চেষ্টা শুরু হয়। পরমাণু যুদ্ধ হলে একটা অস্বাভাবিক শীত ও অন্ধকার নেমে আসতে পারে—সেই সময়টিকে বোঝাতেই ‘পারমাণবিক শীত’ তত্ত্বটি সামনে আনা হয়েছে। কারণ পরমাণু বোমা হামলা হলে ধোঁয়া ও ধুলোয় সূর্যের আলো আবহমণ্ডলে পৌঁছাতে পারবে না।
জলবায়ু পরিবর্তনের চরম বিপর্যয় নিয়ে বিশ্লেষকরা একটি গবেষণা এজেন্ডা প্রস্তাব করেছেন। এতে দুর্ভিক্ষ, চরম শুষ্ক আবহাওয়া, যুদ্ধ ও রোগ—জলবায়ু বিপর্যয়ের এই চার অনুঘটক অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকারি প্যানেল ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জকে (আইপিসিসি) একটি বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করারও আহ্বান জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
ইতোমধ্যে আইপিসিসির একটি প্রতিবেদনে প্রাক-শিল্পযুগ স্তরের চেয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেলে তার প্রভাবের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া দারিদ্র্য বিমোচন, টেকসই উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি নিয়েও এতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। আর সাধারণ মানুষের মধ্যে জলবায়ু বিষয়ক উদ্বেগ ও সচেতনতা আগের চেয়ে বেড়েছে বলে দাবি করা হয়েছে।
নিজেদের ওই বিশ্লেষণ নিয়ে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝুঁকি গবষেণা বিষয়ক সেন্টার ফর এগজিসটেনশিয়াল রিস্কের গবেষক ড. লুক কেম্প বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে মহাবিপর্যয় ঘটতে পারে—এমনটা বিশ্বাস করার বহু কারণ বা যুক্তি রয়েছে। তিনি আরও বলেন, আগের প্রতিটি বড় ধরনের বিলুপ্তির ঘটনায় জলবায়ু পরিবর্তন ভূমিকা রেখেছে। বহু সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে। আবার এটাই ইতিহাতের নতুন গতিপথও তৈরি করেছে।
কেম্প আরও বলেন, বিপর্যয়ের পথ শুধু বিরূপ আবহাওয়ার মতো ঘটনাগুলো বা উচ্চ-তাপমাত্রার সরাসরি প্রভাবের মধ্যেই সীমিত না, বরং অর্থনৈতিক সংকট, সংঘাত ও নতুন নতুন রোগের প্রাদুর্ভাবের মতো বিভিন্ন ঘটনাগুলোও ব্পির্যয় উসকে দিতে পারে।
বিশ্বের শীর্ষ বিজ্ঞানীদের এই বিশ্লেষণ বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী ‘প্রসেডিংস অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’-এ প্রকাশিত হয়েছে সোমবার (১ আগস্ট)। ইতোমধ্যে কয়েক ডজন বিজ্ঞানী এটি পর্যালোচনা করেছেন। বিশ্লেষণটিতে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেলে তার পরিণতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা নিয়ে পর্যাপ্ত মাথা ঘামানো হয়নি। সামগ্রিক প্রভাব নিয়ে কেবল কিছু পরিসংখ্যানগত হিসাব-নিকাশ আছে।
কেম্প বলেন, যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে, তা নিয়ে আমাদের জানাশোনা খুবই নগণ্য।
বিজ্ঞানীরা বলেছেন, কীভাবে ঝুঁকি তৈরি হয়, ছড়িয়ে পড়ে ও বিস্তার লাভ করে; তা বুঝতে একটি পরিপূর্ণ মূল্যায়ন থাকা দরকার। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই চেষ্টাও করা হয়নি। বাস্তব দুনিয়ায় কীভাবে ঝুঁকি তৈরি হয়, তার দৃষ্টান্ত দিয়ে তারা বলেন, ঘুর্ণিঝড় বৈদ্যুতিক অবকাঠামো ধ্বংস করে দেয়। প্রাণঘাতি দাবদাহ জনজীবন বিপন্ন করে তোলে। ঝুঁকি মূল্যায়নে এসব বিষয় থাকা উচিত।
তারা আরও যোগ করেন, বড় ধরনের বৈশ্বিক ঝুঁকি নিয়ে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার; তা দেখিয়ে দিয়েছে করোনা মহামারি। কারণ আগে কখনো মানুষতে ভাবতেও পারেনি যে কোভিড-১৯ বলে কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে।
বিশেষ উদ্বেগ হচ্ছে, বিশ্বে এমন কিছু পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে বৈশ্বিক তাপমাত্রার সামান্য উত্থান ঘটলেও জলবায়ুতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটছে। যেমন, চিরহরিৎ আমাজন বন থেকে বিপুল পরিমাণ কার্বন নিঃসরণে ব্যাপক অনাবৃষ্টি ও দাবানল দেখা দিতে পারে। অর্থাৎ পরিস্থিতি এক অপ্রতিরোধ্য অবস্থায় চলে যেতে পারে।
এছাড়া বরফের আস্তরণ ও সমুদ্রের স্রোত পরস্পরের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। উষ্ণতার কারণে অ্যান্টার্কটিকার বেশ কয়েকটি বরফের আস্তরণ গলতে শুরু করেছে। অর্থাৎ এসব বরফের আস্তরণের পতন আর ঠেকানো যাবে না। এতে আসছে বছরগুলোতে সমুদ্রের স্তর বেড়ে যাবে। আর তা মানুষের জন্য যে ক্ষতিকর পরিণতি বয়ে আনবে, এ নিয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা হয়নি।
যেমন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের নিম্ন-অক্ষাংশ ঢেকে থাকা স্ট্রাটো কিউমুলাস মেঘের আস্তরণ সরে যেতে পারে। আর তাতে বৈশ্বিক উষ্ণতা আট ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। মাঝ আকাশে স্ট্রাটো কিউমুলাস মেঘ আরও ভারী ও গাঢ় রঙরূপ নিয়ে নিচে নেমে আসে। গাঢ় ধূসর থেকে কালো পর্যন্ত হতে পারে এর রং। মেঘটি দেখতে ঘন কুয়াশার মতো। স্তরে স্তরে সাজান এই মেঘ সারা আকাশ ঢেকে ফেলে।
গবেষকেরা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, জলবায়ু সংকটের কারণে আরও বড় বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে। বিশেষ করে বৈশ্বিক যুদ্ধ, সংক্রামক রোগ ও মহামারি প্রকট রূপ নিতে পারে। দারিদ্র্য বেড়ে যাবে, শস্য উৎপাদন ব্যাহত ও সুপেয় পানির সংকট দেখা দেবে।
সূর্যের আলোর প্রতিফলন কিংবা কার্বন নির্গমনের অধিকার নিয়ে ভূপ্রকৌশল পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একদিন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে পরাশক্তিগুলো। এমন শঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো এবং ভবিষ্যৎ চরম উষ্ণতার অঞ্চলগুলো পরস্পরের ওপর প্রভাব ফেলছে বলে দাবি করা হচ্ছে।
বিজ্ঞানীদের মতে, আসছে দশকগুলোতে যদি বর্তমান রাজনৈতিক ঠুনকো অবস্থা থেকে বিশ্ব বেরিয়ে আসতে না-পারে, তবে এই অস্থিতিশীলতা আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে। তার পরিণতিও ভুগতে হবে মানব সভ্যতাকে।
সম্ভাব্য জলবায়ু বিপর্যয় নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কারণের অভাব নেই। অতীত ইতিহাস তা-ই বলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগের অনেক সমাজের পতন কিংবা রূপান্তর ঘটেছে। অনেক সরকার ও সাম্রাজ্যের পতন হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসের পাঁচটি বড় বিলুপ্তির ঘটনায় জলবায়ু পরিবর্তন জড়িত।
নতুন বিশ্লেষণ বলছে, যদি কার্বন নিঃসরণ বর্তমান ধারায় অব্যাহত থাকে, তাহলে ২০৭০ সাল নাগাদ ২০০ কোটি মানুষের ওপর চরম উষ্ণতার প্রভাব পড়তে পারে। চরম উষ্ণতা বলতে বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি।
চীনের ন্যানজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক চি শু বলেন, বর্তমানে চরম উষ্ণতার ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার তিন কোটি মানুষ। ২০১৭ সাল নাগাদ এই তাপমাত্রা ও সামাজিক-রাজনৈতিক পরিণতি দুটি পরমাণু শক্তি এবং বিপজ্জনক রোগজীবাণু থাকা সাতটি সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষাগারে সরাসরি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। কাজেই বড় ধরনের বিপর্যয়ের শঙ্কা উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই।
গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের বর্তমান প্রবণতা ২১০০ সাল নাগাদ দুই দশমিক এক থেকে তিন দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে। কিন্তু বর্তমান অঙ্গীকারগুলো পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করা হলে তা এক দশমিক ৯ থেকে তিন ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকবে। এ পর্যন্ত নেয়া সব দীর্ঘমেয়াদী টার্গেট বাস্তবায়ন হলে বৈশ্বিক উষ্ণতা এক দশমিক সাত থেকে দুই দশমিক ছয় ডিগ্রিতে গিয়ে ঠেকবে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এখন পর্যন্ত যেসব আশাবাদী ধারণা করা হচ্ছে, তাতেও পৃথিবী ব্যবস্থা এক বিপজ্জনক গতিপথে গিয়ে পড়বে। প্রাক-শিল্প স্তরের ওপর দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা পৃথিবীতে ২৬ লাখ বছরের বেশি স্থায়ী ছিল না।
জার্মানির পটসড্যাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইম্যাট ইমপ্যাক্ট রিসার্চের অধ্যাপক জোহান রকস্ট্রম বলেন, আমাদের গ্রহের ক্রিয়াকলাপ নিয়ে যত বেশি আমরা গবেষণা করব, ততই জানতে পারবে যে এখানে ভঙ্গুর জীব রয়েছে। কাজেই বিপর্যয় এড়াতে আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে।