ডেস্ক রিপোর্ট :
সম্প্রতি দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানভীর আরেফিন মৌখিক পরীক্ষা শেষে বাসায় ফিরে নিজ রুমে ফ্যানের সঙ্গে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
শুধু তানভীর আরেফিন নয়, গত আট মাসে (জানুয়ারি-আগস্ট) দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৩৬৪ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণায় জানা যায়, আত্মহননকারী এ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীদের সংখ্যাই বেশি।
আঁচল ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, গত আট মাসে ১৯৪ বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এছাড়া কলেজ পড়ুয়াদের মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন ৭৬ জন, মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ৪৪ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ৫০ জন।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি মাসে গড়ে ৪৫ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করছেন। এদের মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা ছাত্রদের চেয়ে বেশি।
ছাত্রীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা এতো বেশি কেন- এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সাদেকা হালিম সময় সংবাদকে বলেন, সামাজিকভাবে যখন একটি মেয়েকে তার পরিবার বড় করছে, শুরু থেকেই শেখানো হচ্ছে তাকে নম্র-ভদ্র থাকতে হবে। আমাদের সমাজে একটি ছেলে যখন আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে তাকে একটি কথাই বলা হয়- ছেলে হিসেবে তোমাকে আবেগপ্রবণ হলে চলবে না। সামনে তোমার দিনগুলো আরও কঠিন। কিন্তু মেয়ে শিশুর ক্ষেত্রে একদম উল্টো কথা বলা হয়। একটা মেয়েকে তার পরিবার বড়ই করে আবেগপ্রবণ মানুষ হিসেবে। এতে করে অল্প হতাশায় কিংবা সামান্য কষ্টে একটি মেয়ে আত্মহত্যার মতো মারাত্মক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে।
সাদেকা হালিম বলেন, বর্তমান সময়ের সম্পর্কের কথাগুলোই ধরা যাক। একটি ছেলে-মেয়ের মধ্যে যখন সখ্য গড়ে ওঠে সেটা কিন্তু আর চা-কফির মধ্যে বিদ্যমান থাকে না। এটি অনেক সময় শারীরিক সম্পর্কের দিকে মোড় নেয়। পরে ছেলেটা যখন চলে যায় কিংবা সম্পর্ক ভেঙে যায়- মেয়েটি ভাবে সে অপমানিত হয়েছে। এটা একটা সামাজিক সমস্যা। অনেক সময় নানা স্পর্শকাতর জিনিস নিয়ে মেয়েদের ব্ল্যাকমেইল করা হয়। তখন না পারে কারও সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলতে, না পারে কোনো সাহায্য নিতে। বেশিরভাগ সময় মেয়েটির পরিবারই তাকে দোষারোপ করে। মরে যাওয়ার আগেই তার পরিবার তাকে অর্ধেকটা মেরে ফেলে। মেয়েটির মানসিক জায়গা এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় যে, তার আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
যেখানে শৈশব হওয়ার কথা জীবনের এক সোনালী অধ্যায়, ছাত্রজীবন হওয়ার কথা সুখময় ও অধ্যয়নের স্থান, সেখানে শিক্ষার্থীরা কেন আত্মহত্যা করছেন? কেন এত হতাশ তারা?
কী করলে আত্মহত্যার হার কমবে- জানতে চাইলে সাদেকা হালিম বলেন, আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে জোর দিতে হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা থাকলে আত্মহত্যার হার কমে আসবে।
শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা করার পেছনে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, স্কুল ও কলেজপড়ুয়া সিংহভাগ শিক্ষার্থী প্রেমঘটিত কারণে এবং বাবা-মায়ের সঙ্গে অভিমান করে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মূলত সম্পর্কে জটিলতা, পারিবারিক সমস্যা, পড়ালেখার চাপ, আর্থিক সংকট ও সর্বোপরি মানসিক বিষণ্ণতার কারণে আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন।
২০২১ সালের আঁচল ফাউন্ডেশনের এক সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, করোনাকালে গত বছর মোট ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। ফাউন্ডেশনটির গবেষণায় দেখা যায়, আত্মহত্যা করা এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে নানা ধরনের জটিলতায় ভুগছিলেন ২৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ, পারিবারিক সমস্যায় ছিলেন ১৯ দশমিক ৮০ শতাংশ, মানসিক চাপের মধ্যে ছিলেন ১৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ, পড়াশোনা নিয়ে চাপের মধ্যে ছিলেন ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এছাড়াও আর্থিক সংকট, মাদকাসক্ত ও অন্যান্য কারণে ২৮ দশমিক ৭১ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন।
সম্পর্কে জটিলতা ও পারিবারিক সমস্যার কারণে কীভাবে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে- এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শাহ এহসান হাবিব সময় সংবাদকে বলেন, বর্তমান সময়ে তরুণ বয়সের এ শিক্ষার্থীদের জীবন অনেকাংশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নির্ভর। এই জেনারেশনটিকে ফেসবুক জেনারেশন বলা যায়। এখানে সম্পর্ক-আড্ডা পুরোটাই ভার্চুয়াল। একটি ভার্চুয়াল দুনিয়ায় সামনাসামনি কথা বলা, শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে হালকা হওয়া- এ জিনিসগুলো একেবারেই কমে গেছে। সবাই নিজেদের মতো থাকতে চাচ্ছে। এতে করে তাদের ভেতরকার হতাশাগুলো আরও জটিল হচ্ছে- যেটি একটি সময়ে তাদের আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
শাহ এহসান হাবিব বলেন, আমাদের ঢাকায় বিনোদন কিংবা অবসর যাপনের কিছুই কিন্তু নেই। শিক্ষার্থীদের জীবন হয়ে উঠছে একমুখী। এতে করে এরা মানসিক চাপের মধ্যে থাকে। একটা দমবন্ধ পরিস্থিতির মধ্যে থেকে থেকে তারা বিষণ্ণ হয়ে ওঠে- যার ফলাফল শেষমেশ আত্মহত্যা।
কেউ আত্মহত্যার আগে কিংবা বিষণ্ণতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে কারও সঙ্গে কিছু শেয়ার করতে গেলে বা নিজের মতো করে কথা বলতে গেলে কেনো তার কথা গুরুত্ব সহকারে দেখা হয় না, কিংবা তাকে কেন মানসিকভাবে দুর্বল ভাবা হয়- এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শাহ এহসান হাবিব বলেন, মন খারাপ জিনিসটাকে আমরা একটা ফ্যাশনের পর্যায়ে নিয়ে গেছি। আশপাশে দেখবেন সবারই মন খারাপ। এতে করে যে আসলেই মারাত্মক রকমের হতাশ, যে বিষণ্ণতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে আছে তাকে আলাদা করা যায় না।