নিউজ ডেস্ক:
ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করে ফারমার্স ব্যাংকের চার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ (এস কে সিনহা) ১১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট আদালতে পেশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
আদালতে দুদকের জিআর শাখা থেকে মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ ও সিনিয়র স্পেশাল জজ কে. এম. ইমরুল কায়েসের কাছে চার্জশিটটি জমা দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, দুদক পরিচালক ও তদন্ত কর্মকর্তা বেনজীর আহম্মদ চার্জশিটটি প্রথমে জিআর শাখায় জমা দেন। পরে ওই শাখা থেকে সিনিয়র স্পেশাল জজের কাছে পেশ করা হয়। শিগগির এই চার্জশিটটি নিয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
দুদক তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদনের আলোকে গত ৪ নভেম্বর কমিশন চার্জশিটটির অনুমোদন দিয়েছে। চলতি বছরের গত ১০ জুলাই দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন বাদী হয়ে কমিশনের সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ সিনহাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মামলাটি করেছিলেন।
চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত অন্য দশ আসামি হলেন- ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক এমডি এ কে এম শামীম, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক ক্রেডিট প্রধান গাজী সালাহউদ্দিন, ক্রেডিট বিভাগের ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট শাফিউদ্দিন আসকারী, ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. লুৎফুল হক, টাঙ্গাইলের ধনবাড়ির যদুনাথপুরের মো. শাহজাহান, একই গ্রামের নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা, সাভারের শ্রীমতি সান্ত্রী রায় (সিমি), সাভারের শ্রী রনজিৎ চন্দ্র সাহা ও ব্যাংকের অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুল হক চিশতী (বাবুল চিশতী)।
জানা গেছে, মামলার ১১ আসামির মধ্য থেকে ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখার সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক ও সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. জিয়া উদ্দিন আহমেদকে ওই মামলায় আসামি করা হয়েছিল। মামলা তদন্তকালে মৃত্যুবরণ করায় চার্জশিটে তাকে আসামির তালিকা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। চার্জশিটে আসামির তালিকায় নতুন করে ফারমার্স ব্যাংকের অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুল হক চিশতীর (বাবুল চিশতী) নাম অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
চার্জশিটে ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করে পে অর্ডারের মাধ্যমে নিজের হিসাবে স্থানান্তর করে ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে চার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করা হয়েছে সিনহাসহ ওই ১১ জনের বিরুদ্ধে। ২০১৬ সালের নভেম্বর থেকে গত বছরের সেপ্টম্বর পর্যন্ত সময়ে দুর্নীতির মাধ্যমে ওই পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটে।
চার্জশিটে বলা হয়, আসামিরা অসৎ উদ্দেশে পরস্পর যোগসাজসে ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে ফারর্মাস ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে চার কোটি টাকার ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করেছিলেন। পরে ওই টাকা ঋণ সৃষ্টির দিনে পে অর্ডারের মাধ্যমে সিনহার ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর ও উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়। অবৈধ প্রকৃতি, উৎস, অবস্থান গোপন করে পাচারে সংঘবদ্ধ থেকে আসামিরা দন্ডবিধি-১৮৬০ এর ৪০৯, ৪২০,১০৯, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন-১৯৪৭ এর ৫(২) ধারা ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ এর ৪(২), (৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
চার্জশিটে আরও বলা হয়, জনৈক মো: শাহাজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর তারিখে ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় পৃথক পৃথক ২টি চলতি হিসাব খোলেন। এর পরেরদিন ৭ নভেম্বর উভয়ে পৃথক পৃথক ভাবে দুই কোটি করে মোট চার কোটি টাকার ব্যবসা বৃদ্ধির ঋণ আবেদন করেন। তারা ব্যাংক হিসাব ও ঋণ আবেদনে রাজধানীর উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডের ৫১ নম্বর বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করেন। এই বাড়িটি এস কে সিনহার ব্যক্তিগত বাড়ি বলে দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। ঋণের জামানত হিসাবে জনৈক রনজিৎ চন্দ্র সাহার স্ত্রীর নামের সাভারের ৩২ শতাংশ জমির তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। তারা দুজন সিনহার পূর্ব পরিচিত ও ঘনিষ্ঠজন।
ওই ঋণ আবেদন দু’টি কোন রকম যাচাই-বাছাই ছাড়া, ব্যাংকের নিয়ম-নীতি না মেনে শুধুমাত্র গ্রাহকের আবেদনের ওপর ওই শাখার ম্যানেজার মো. জিয়াউদ্দিন আহমেদসহ শাখার লুৎফল হক ও শাফিউদ্দিন আসকারী মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঋণ প্রস্তাব তৈরি করে তাতে স্বাক্ষর করেন। এরপর জিয়াউদ্দিন আহমেদ হাতে হাতে ঋণ প্রস্তাব ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে যান। প্রধান কার্যালয়ের ক্রেডিট কমিটির কর্মকর্তা স্বপন কুমার রায় ওই ঋণ প্রস্তাব দু’টি কোনরূপ যাচাই না করে অফিস নোট তৈরি করে তাতে স্বাক্ষর করেন। পরে ক্রেডিট প্রধান গাজী সালাহউদ্দিনের কাছে নিয়ে যান, গাজী সালাহউদ্দিনও যাচাই না করে ব্যাংকের তৎকালীন এমডি এ কে এম শামীমের কাছে নিয়ে যান। ব্যাংকের ঋণ পলিসি অনুযায়ী এমডির প্রস্তাব দু’টি অনুমোদন করার ক্ষমতা না থাকা সত্বেও তিনি যাচাই বাছাই বা নির্দেশনা না দিয়ে ঋণ প্রস্তাব দু’টির অনুমোদন দেন।
ঋণ প্রস্তাব দু’টি মঞ্জুর হওয়ার পরের দিনই ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর চার কোটি টাকা পৃথক দুটি পে অর্ডার এস কে সিনহার নামে ইস্যু করা হয়। পরে ওই টাকা সিনহার নামে সোনালী ব্যাংকের সুপ্রীম কোর্ট শাখার হিসাব নং: ৪৪৩৫৪৩৪০০৪৪৭৫তে পে অর্ডারের পরের দিন ৯ নভেম্বর ৪ কোটি টাকা জমা হয়।
পরে সাবেক বিচারপতি সিনহা বিভিন্ন সময়ে অস্বাভাবিক ক্যাশ ও চেক/পে অর্ডারের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে ওই হিসাব থেকে টাকা উত্তোলন করেন। এর মধ্যে অন্য একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের উত্তরা শাখায় তার আপন ভাইয়ের নামের ৪০০৮১২১০০০৪৯০৪২ হিসাবে দু’টি চেকের মাধ্যমে ২০১৬ সালের ২৮ নভেম্বর ১ কোটি ৪৯ লাখ ৬ হাজার ও ৭৪ লাখ ৫৩ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয়। পরে ওই হিসাব থেকে বিভিন্ন সময়ে ক্যাশ/চেকের মাধ্যমে ওই টাকা উত্তোলন করা হয়। আসামি রনজিৎ চন্দ্র সাহা ব্যাংকে উপস্থিত থেকে ঋণ আবেদন দ্রুত অনুমোদনের জন্য প্রধান বিচারপতির নাম উল্লেখ করে প্রভাব খাটিয়েছিলেন। এছাড়া ঋণ আবেদনকারী নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা রনজিৎ চন্দ্র সাহার ভাতিজা ও মো: শাহ জাহান রনজিৎ চন্দ্র সাহার ছোটকালের বন্ধু। তারা দু’জনই অত্যন্ত গরীব, দুস্থ। তারা কখনো ব্যবসা-বাণিজ্য করেননি বা তাদের কোন ব্যবসা নেই মর্মে প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয়। সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা রনজিৎ চন্দ্র সাহার মাধ্যমে তাদের ভুল বুঝিয়ে ব্যাংকের কাগজপত্রে স্বাক্ষর নেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন।
আলোচিত সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সিতে তার ভাই অনন্ত কুমার সিনহার নামে কেনা বাড়িতে অবস্থান করছেন বলে একাদিক সূত্রে জানা গেছে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ও কিছু পর্যবেক্ষণের কারণে ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে ২০১৭ সালের অক্টোবরের শুরুতে ছুটিতে যান সাবেক এই প্রধান বিচারপতি। তিনি একই বছরের ১৩ অক্টেবর অষ্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন। অষ্ট্রেলিয়া থেকে সিঙ্গাপুর যান ৬ নভেম্বর। পরে ১০ নভেম্বর সিঙ্গাপুর থেকে কানাডায় যাওয়ার পথে সেখানকার বাংলাদেশ হাইকমিশনে রাষ্ট্রপতি বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দেন। রাষ্ট্রপতি তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন গত বছরের ১৪ নভেম্বর।