পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব। আর এই উৎসব যেন নতুন প্রাণ ছুঁয়ে দিয়েছে গোটা বরিশালকে। সকাল গড়াতেই শহরের অলিগলি থেকে শুরু করে প্রধান সড়ক, পার্ক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোতে উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। সব বয়সের নারী-পুরুষ একসাথে বৈশাখের উৎসবে মেতে উঠেছেন। দিনভর চলে প্রাণের এই উৎসব। ঊুড়রপ ঊুড়রপ সকাল নয়টায় বরিশাল সার্কিট হাউজ থেকে শুরু হওয়া বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ হাতে মুখোশ, কাঁধে ঢাক-ঢোল নিয়ে অংশগ্রহণ করেন। মঞ্চে গান, কবিতা, নৃত্য আর পটচিত্রে ভরপুর ছিল সার্কিট হাউস চত্বর ও বেলস পার্ক। ‘নববর্ষের ঐক্যতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’ শ্লোগানে মুখর ছিল গোটা বরিশাল। গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি হিসেবে পালকি, চাষি, জেলে ও ঐতিহ্যবাহী সরঞ্জাম ছিল প্রধান প্রদর্শনীতে।
বাংলা নববর্ষ ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বরিশাল সার্কিট হাউস প্রাঙ্গন থেকে সকাল ৯ টায় শুরু হওয়া আনন্দ শোভাযাত্রা, সার্কিট হাউস প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও পুরস্কার বিতরণীতে অংশগ্রহণ করেন বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনারজনাব মোঃ শফিকুল ইসলাম ।
এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন বিভাগীয় কমিশনার বরিশাল মোঃ রায়হান কাওছার, রেঞ্জ ডিআইজি বরিশাল জনাব মোঃ মঞ্জুর মোর্শেদ আলম, জেলা প্রশাসক বরিশাল মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, পুলিশ সুপার বরিশাল মোঃ শরিফ উদ্দিন, বিপিএম,বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষক মন্ডলী ও কোমলমতি শিক্ষার্থীসহ নানান শ্রেণী পেশার ব্যক্তিবর্গ ।এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ।
বৈশাখ মানেই পান্তা-ইলিশ আর সংস্কৃতির বন্ধন। তাই নগরীর রেস্টুরেন্টগুলোতে আয়োজন করা হয়েছিল বৈশাখী বিশেষ মেনু। ইলিশ-পান্তা, বেগুন ভাজি, খেজুরের পায়েসে জমে ওঠে বৈশাখের স্বাদ। অনেকেই পরিবারসহ হোটেল কিংবা বাড়িতে আয়োজন করেন দিনব্যাপী ভোজ। সাংস্কৃতিক আয়োজনে রঙ ছড়াতে বরিশাল নগরীর বেলস পার্কে স্থাপন করা হয় প্রায় অর্ধশতাধিক স্টল, যেখানে লোকজ শিল্প, পণ্য ও খাবারের সমাহার ছিল। পাশাপাশি সার্কিট হাউস চত্বরে বরিশাল সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, জাসাস, হেরারশ্মি, অমৃত লাল দে কলেজ, বিএম স্কুল, শিল্পকলা একাডেমি—সব জায়গায় দিনভর চলে একের পর এক বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বরিশাল প্লানেট ওয়ার্ল্ড শিশু পার্কে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে প্রাতঃভ্রমণ পরিষদের বৈশাখী সাংস্কৃতিক আয়োজন। জেলার বাইরে বৈশাখের সবচেয়ে বড় আয়োজন করা হয়েছিল গৌরনদীতে। উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও পৌর প্রশাসক মো. আবু আবদুল্লাহ খানের নেতৃত্বে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা শেষে বাঙালিয়ানা খাবারের আয়োজন, দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও শিশুদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়।
ফিরে চল মাটির টানে এই স্লোগানে বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ কে স্বাগত জানিয়ে নানা আয়োজন করা হয়েছে বরিশালে। বরিশাল উদিচী শিল্পগোষ্ঠীর আয়োজনে বৈশাখী মেলা প্রভাতি অনুষ্ঠান নগরীর ঐতিহ্যবাহি ব্রজমোহন (বিএম) স্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সোমবার (১৪ এপ্রিল) সকাল ৮টায় বর্ষবরন ও রাখি পরানোর মধ্যে দিয়ে বৈশাখ উৎসব আনন্দ শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। বিএম স্কুল মাঠ প্রাঙ্গন থেকে হাতি, ঘোড়া, ফুল ও বাংলাদেশের পতাকা প্রদর্শন করে এক বনাঢ্য র্যালি বের হয়ে নগরীর প্রধান সড়ক গুলো প্রদক্ষিন করে সদর রোডে এসে শেষ হয়। মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব, নাট্যকর্মী ও সনাতন ধর্মালম্বিদের সমন্বয়ে বিভিন্ন সাজে সজ্জিত হয়ে এই র্যালিতে অংশ গ্রহন করেন। এসময়ে শান্তিময় পৃথিবী গড়ার আহবান জানান তারা। তবে বিগত বছরের চেয়ে এবার অনেক সিমিত আকারে এই আনন্দযাত্রা হয়।
এছাড়া দিনটি উপলক্ষে জেলা প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশন এবং বিএনপির উদ্যোগেও পৃথক পৃথক আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়।
এদিকে সকাল সাড়ে ১০টায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে (ববি) বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হয়। এসময় শোভাযাত্রায় ববি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিনসহ শিক্ষক শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। বরিশাল জেলা প্রশাসক দেলোয়ার হোসেন বলেন, সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপন হচ্ছে। এসময় সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানান তিনি
এই উৎসব থেকে যেন সমাজের পিছিয়ে পড়া শিশুরা বাদ না পড়ে—সেই লক্ষ্যেই ব্যতিক্রমধর্মী এক আয়োজন করে সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের উদ্যোগে গঠিত সংগঠন ইভেন্ট-৮৪। বরিশালের তরঙ্গ ও এসএনডিসি’র পাঠশালার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে নগরীর মুক্তিযোদ্ধা পার্কে আয়োজন করা হয় বৈশাখী উৎসব। এই আয়োজনে শিশুদের মুখে হাসি ফোটে যখন তারা নতুন পোশাক ও খাবার হাতে পায়। বাংলা ভাষা, বাঙালির ঐতিহ্য ও রীতিনীতি সম্পর্কে জানার সুযোগও হয় তাদের। এই আনন্দঘন মুহূর্ত আরও বিশেষ হয়ে ওঠে বরিশালের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনের উপস্থিতিতে। জেলা প্রশাসকের হাত থেকে নতুন পোশাক ও নাস্তা পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে শিশুরা। সকালবেলার এই আয়োজন তাদের জীবনে নিয়ে আসে ভিন্নরকম আনন্দের মাত্রা। এ সময় জেলা প্রশাসক বলেন, “পহেলা বৈশাখের উৎসব থেকে যেন সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা বঞ্চিত না হয়, সে লক্ষ্যেই ইভেন্ট-৮৪ এর এই ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজন অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আমি তাদের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।” তিনি আরও বলেন, “আশা করি, ভবিষ্যতেও এমন উৎসবমুখর দিনগুলোতে তারা এই ধরনের ব্যতিক্রমী আয়োজন অব্যাহত রাখবে। আমি সবসময় এই মহতী উদ্যোগের পাশে থাকব। আগামী দিনে পহেলা বৈশাখ উদযাপন হবে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়েই।