বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে দুই শর্তে জামিন মঞ্জুর করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। যে দুই শর্তে মিন্নিকে জামিন দেয়া হয়েছে তা হলো- মিন্নি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না ও তাকে তার বাবার জিম্মায় থাকতে হবে।
হাইকোর্টের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন। জামিনে থাকা অবস্থায় মিন্নি গণমাধ্যমের সাথে কথা বললে তার জামিন বাতিল হবে বলেও আদেশে উল্লেখ করেন আদালত। মিন্নির জামিন প্রশ্নে জারি করা রুলের শুনানি শেষে এ রায় এলো।
আদালতে মিন্নির জামিনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী জেড আই খান পান্না, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট এ এম আমিন উদ্দিন, সাবেক বিচারপতি অ্যাডভোকেট মুনসুরুল হক চৌধুরী, আইনজীবী মমতাজ উদ্দিন মেহেদী, অ্যাডভোকেট জেসমিন সুলতানা, আইনুন নাহার সিদ্দিকা, ব্যারিস্টার অনিক আর হক, আইনজীবী এম মঈনুল ইসলাম, মাক্কিয়া ফাতেমা ইসলাম, রোহানি সিদ্দিকা, সাহাবুদ্দিন লার্জ, জামিউল হক ফয়সাল প্রমুখ।
রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারোয়ার হোসেন বাপ্পী ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল শাহানা পারভীন। অ্যামিকাস কিউরি (আদালত বন্ধু) হিসেবে সিনিয়র আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী বক্তব্য দেন।
রায় ঘোষণারর সময় হাইকোর্ট বলেন, ‘এজাহারে আসামির নাম উল্লেখ না থাকা; গ্রেফতারের আগে দীর্ঘ সময় মিন্নিকে পুলিশ লাইন্সে আটক রাখা এবং গ্রেফতারের প্রক্রিয়া; আদালতে হাজির করে রিমান্ড শুনানির সময় তার আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ না পাওয়া; ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক লিপিবদ্ধ করার আগেই আসামির দোষ স্বীকার সম্পর্কিত জেলা পুলিশ সুপারের বক্তব্য; তদন্তকারী কর্মকর্তার মতে মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে, সুতরাং আসামি কর্তৃক তদন্ত প্রভাবিত করার কোনো সুযোগ না থাকায়; সর্বোপরি ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৮, ৯৭ ধারার ব্যতিক্রম, অর্থাৎ আসামি একজন নারী- এ বিষয়গুলো বিবেচনা করে আমরা তাকে জামিন দেওয়া ন্যায়সঙ্গত মনে করছি এবং জারি করা রুলটি আমরা যথাযথ ঘোষণা করলাম। সে তার বাবার জিম্মায় থাকবে এবং মিডিয়ার সামনে কোনো কথা বলতে পারবে না।’
আদালত বলেছেন, জামিনে থাকা অবস্থায় ১৯ বছর বয়সী ওই তরুণী তার বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোরের জিম্মায় থাকবেন। এ সময়ে মিন্নি গণমাধ্যমের সামনে কোনো কথা বলতে পারবেন না।
মেয়ের জামিন হওয়ায় আদালতে উপস্থিত মোজাম্মেল হোসেন কিশোর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি খুব খুশি যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দুষ্কৃতকারীরা যেগুলো করছে, এগুলো সব জনসম্মুখে প্রচার পেয়েছে।’
মিন্নির বাবা অভিযোগ করে আসছেন, ‘নির্যাতন করে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে’ মিন্নিকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছে পুলিশ। এর পেছনে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের হাত আছে বলেও তার দাবি।
মিন্নির আইনজীবী জেডআই খান পান্না রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, মিন্নির জামিন মঞ্জুর হয়েছে। তবে তার প্রতি একটা নির্দেশনা আছে। সে মিডিয়ার সামনে কথা বলতে পারবে না।
অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারোয়ার হোসেন বাপ্পি বলেন, এ রায়ে আমরা মর্মাহত। রাষ্ট্রপক্ষ এ রায়ের বিরুদ্ধে নিয়মিত লিভ টু আপিল করবে।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, জামিনে আদালত শর্ত দিয়েছেন। সে (মিন্নি) জামিনের অপব্যবহার করলে নিম্ন আদালত তার জামিন বাতিল করতে পারবেন।
মিন্নির জামিন কেন দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে গত ২০ আগস্ট রুল জারি করেছিলেন আদালত। এর আগে গত ৩০ জুলাই বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান মিন্নির জামিন নামঞ্জুর করে আদেশ দেন। তার আগে গত ২১ জুলাই বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মো. সিরাজুল ইসলাম গাজীর আদালত মিন্নির জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করেন। এরপর মিন্নির জামিনের বিষয়টি হাইকোর্টে আসে।
গত ২৬ জুন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে রিফাত শরীফকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। যার ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হলে দেশে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়।
এ ঘটনায় রিফাতের বাবা আবদুল হালিম শরীফ বাদী হয়ে ১২ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। তাতে প্রধান সাক্ষী করা হয় রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়শাকে। কিন্তু আয়শার শ্বশুর মামলার ১৮ দিন পর গত ১৩ জুলাই এই হত্যাকাণ্ডে আয়শা জড়িত এমন দাবি করে সংবাদ সম্মেলন করার পর মামলাটির তদন্ত নাটকীয় মোড় নেয়। পরে এ মামলায় গ্রেফতার করা হয় মিন্নিকে। এ মামলায় এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হওয়া সবাই আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। গত ২ জুলাই এ মামলার প্রধান আসামি সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।