আমতলী (বরগুনা) প্রতিনিধি।
ডিগ্রী পাসের ভূয়া সনদ দেখিয়ে বকুলনেছা মহিলা কলেজের অধ্যক্ষে হিসেবে নিয়োগ নেন মোঃ ফোরকান মিয়া। জাল সনদ ধরা পরায় স্বেচ্ছায় অধ্যক্ষ পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ৮ বছর পরে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে কলেজের এডহক কমিটি গঠন করে পুনঃরায় কলেজের অধ্যক্ষের পদ দখল করেন। এ ঘটনায় বরগুনা জেলা প্রশাসক তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। মঙ্গলবার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) শুভ্রা দাশ তার কার্যালয়ে তদন্ত শুরু করেছেন।
জানাগেছে, আমতলী বকুলনেছা মহিলা ডিগ্রী কলেজে ১৯৯৯ সালে মোঃ ফোরকান মিয়া বিএ (পাস) জাল সার্টিফিকেট গোপন রেখে ইসলামী শিক্ষা বিষয়ের প্রভাষক পদে চাকুরী নেন। ২০১০ সালে তিনি জাল জালিয়াতির মাধ্যমে ওই কলেজের অধ্যক্ষ পদে আসীন হন। অধ্যক্ষ পদে আসীন হওয়ার তিন বছরের মাথায় ২০১৩ সালে দুর্ণীতি, অর্থ আত্মসাৎ ও সার্টিফিকেট জালিয়াতির অভিযোগে কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটি তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। সাময়িক বরখাস্তের পরেই ডিগ্রী পাসের জাল সার্টিফিকেটের তথ্য বেড়িয়ে আসে।
মোঃ ফোরকান মিয়া আমতলী সরকারী কলেজে ১৯৯০-৯১ শিক্ষা বর্ষে বিএ শ্রেনীতে ভর্তি হন। ১৯৯২ সালের ডিগ্রী পাস (অনুষ্ঠিত ১৯৯৩ সালে) নিয়মিত ছাত্র হিসেবে পরীক্ষায় অংশ গ্রহন করেন। তার রেজিষ্ট্রশন নম্বর- ৫৩৭৫০ ও রোল নং- ৬৫৮। তিনি ওই বছর পরীক্ষায় অংশগ্রহন করলেও তার ফলাফল স্থগিত থাকে। কিন্তু তিনি জালিয়াতি করে ওই বছরই বিএ পাস সার্টিফিকেট সংগ্রহ করেন এবং ওই সার্টিফিকেট দিয়েই বকুলনেছা মহিলা কলেজে চাকুরী নেন। কিন্তু আমতলী সরকারী কলেজ থেকে তিনি বিএ পাস পরীক্ষায় অংশগ্রহন করে উত্তীর্ণ হয়নি মর্মে ওই কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ মজিবুর রহমান প্রত্যয়ন পত্র দেন। এ ঘটনার পর তিনি স্বেচ্ছায় বকুলনেছা মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপরও তার সার্টিফিকেটের যাচাই বাছাইয়ের জন্য কলেজের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রনব কুমার সরকার ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের বরাবরে আবেদন করেন। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. হিমাদ্রী শেখর চক্রবতী মোঃ ফোরকান মিয়ার ডিগ্রী (পাস) ১৯৯২ সনদ জাল মর্মে প্রত্যয়ন দেন। তার বিএ পাস জাল সার্টিফিকেটের বিষয়ে ২০১৩ সালে আমতলী সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা হয়। আদালতে ফোরকান মিয়া তার আমতলী কলেজের ডিগ্রী পাসের সনদ অস্বীকার করে প্রিমিয়াম ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি নামক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডিগ্রী পাসের সনদ দাখিল করেন। কিন্তু বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনে উক্ত সনদপত্রের সত্যতা যাচাই করতে গেলে, বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের উপ-পরিচালক জেসমিন পারভীন স্বাক্ষরিত একটি পত্রের মাধ্যমে জানান, প্রিমিয়াম ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি নামক তথাকথিত প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত নয় এবং অননুমোদিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ডিগ্রী গ্রহণযোগ্য নয়।
২০১৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেন ব্যবস্থাপনা কমিটি। কিন্তু মোঃ ফোরকান মিয়া ওই সময় মহামান্য হাইকোর্টে পদ, বেতন ভাতা ফিরে পাওয়া ও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বন্ধে হাইকোর্টে রীট পিটিশন দাখিল করেন। মহামান্য হাইকোর্টের বিচারক অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন। কিন্তু তার অধ্যক্ষ পদ পুনর্বহাল এবং বেতন ভাতার বিষয়ে কোন আদেশ দেয়নি।
এদিকে গত ১২ জুলাই পদত্যাগকৃত অধ্যক্ষ মোঃ ফোরকান মিয়া রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোঃ মজিবুর রহমানের স্বাক্ষর জাল করে ফরোয়াডিং দিয়ে অবৈধভাবে জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় থেকে এডহক কমিটির গঠন করেন। ওই কমিটি মহামান্য হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে গত ১৯ জুলাই মোঃ ফোরকান মিয়াকে অবৈধভাবে অধ্যক্ষের চেয়ারে বসিয়ে দেন। এ নিয়ে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। এ ঘটনায় বরগুনা জেলা প্রশাসক মোঃহাবিবুর রহমান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) শুভ্রা দাশকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করেন। মঙ্গলবার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) শুভ্রা দাশ তার কার্যালয়ে তদন্ত শুরু করেছেন।
কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোঃ মজিবুর রহমান বলেন, মহামান্য হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে বর্তমান এডহক কমিটি জাল সার্টিফিকেটধারী মোঃ ফোরকান মিয়াকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিয়েছেন। যা হাইকোর্টের আদেশ অবমাননার শামিল। তিনি আরো বলেন, ফোরকান আমার স্বাক্ষর জাল করে জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় এডহক কমিটি পরিবর্তনের আবেদন করেছেন। তদন্ত কমিটির সম্মুখ্যে আমি লিখিতভাবে সব কিছু জানিয়েছি।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত পদত্যাগকৃত অধ্যক্ষ মোঃ ফোরকান মিয়া তদন্ত কমিটিতে উপস্থিত হওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ২০১৩ সালে তৎকালীন ব্যবস্থাপনা কমিটি জোরপূর্বক আমার কাছ থেকে পদত্যাগপত্র নিয়েছেন। আমি তখন স্বেচ্ছায় পদত্যাগপত্র দেইনি। জাল সার্টিফিকেটের বিষয়ে ফোরকান মিয়া বলেন, আমতলী কলেজের ডিগ্রী পাসের সার্টিফিকেট আমার না, ওটা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আমার নামে বানিয়েছে। কিন্তু প্রিমিয়াম ইউনিভার্সিটি এন্ড টেকনোলজি কর্তৃক দেয়া ডিগ্রীর সনদপত্র বৈধ বলে তিনি দাবি করেন।
বরগুনা জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) শুভ্রা দাশ বলেন, বকুলনেছা মহিলা ডিগ্রী কলেজের তদন্ত শুরু হয়েছে। যথাসময়ে প্রতিবেদন দেয়া হবে।
বরগুনা জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, নতুন এডহক কমিটি গঠন এবং পদত্যাগকৃত অধ্যক্ষকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।