শাহাদাৎ হোসেন, তালতলী (বরগুনা) প্রতিনিধি:
চারদিকে সবুজ সারি সারি গাছ সামনে বিশাল সমুদ্র সৈকত এক কথায় অসাধারন একটি পর্যটক স্পর্ট তালতলী টেংরাগিরি ইকোপার্ক ও সোনাকাটা সমুদ্র সৈকত। বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলা শহর থেকে প্রায় ২৪ কিলোমিটার দূরে এই বনটিতে রয়েছে বিভিন্ন বিলুপ্ত প্রজাতির অসংখ্য সারি সারি গাছ ও ইকো পার্কের পাশেই আরেকটি আকর্ষণীয় স্থান সোনাকাটা সমুদ্র সৈকত। সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়ালে ঝিরিঝিরি বাতাসে মন মুগ্ধ হয়ে যায়। সুন্দরবনের এক অংশ নিয়ে বিশাল বনভূমির উপর টেংরাগিরি ইকো পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে।
প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত পর্যটকরা টেংরাগিরি বন ও সোনাকাটা সমুদ্র সৈকতের একটু স্বাদ নিতে আসেন। সম্প্রতি সময়ে রাস্তাঘাট ও নিরাপত্তা নিয়ে পর্যটকদের নানান অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল এই ট্যাংরাগিরি বনটি এখন অবহেলায়, অরক্ষায় পড়ে আছে।
পর্যটনসমৃদ্ধ এসব এলাকা পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা তো দূরের কথা, এখনো নিরাপদই হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। সর্বশেষ গত (১ এপ্রিল ২০২১) দুলাভাইয়ের সাথে বেড়াতে গিয়ে শালী সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ ঘটনায় ইকো পার্কের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।
স্থানীয় তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বেড়াতে আসা নারী পর্যটকরা। ইকো পার্কের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড নেই। নেই কোনো উদ্ধারকর্মী, নেই টহলের ব্যবস্থা। টেংরাগিরি বন এর মধ্যে কুমিরের বেষ্টনী দেখতে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে প্রাণ হারান মোঃ রনি নামের এক পর্যটক। সেই সময়ে উদ্ধারকর্মী ও টহল ব্যবস্থা না থাকায় প্রায় পাচ ঘণ্টা পরে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
এছাড়াও দিনদিন উজাড় হয়ে যাচ্ছে টেংরাগিরি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গাছ স্থানীয় কয়েকটি সংঘবদ্ধচক্র বনে মধু সংগ্রহ ও পশু চারণে কথা বলে ঢুকে বনের গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে এবং নির্বিচারে পাচার করে দিচ্ছে।
একাধিক পর্যটকদের সাথে আলাপকালে তারা জানান, বনের মধ্যে গহীনজঙ্গলে সংঘবদ্ধ চক্র লুকিয়ে থাকে নারী পর্যটকদের একা পেলেই তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে নারী পর্যটকরা এখনে অাসতে ভয় পায়। মূলত বনের মধ্যে নিরাপত্তা আরো জোরদার করতে হবে। এছাড়াও যাতায়াতের জন্য রাস্তা সংস্কার ও পর্যটক এলাকায় হোটেল-মোটেল তৈরি সহ নানা ধরনের উদ্যোগ নিলে টেংরাগিরি বন টি আবার সুনাম ছড়িয়ে পরবে।
জানা জায়, ১৯৬০ সালের ১২ ই জুলাই সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা দেয় বন বিভাগ পরে ১৯৬৭ সালের এই বনাঞ্চলটিক টেংরাগিরি বন নামকরণ করে ঘোষণা দেয়।
এর আগে স্থানীয়দের কাছে হরিণঘাটার বন, পাথরঘাটার বন ও ফাতরার বনসহ বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল।
সুন্দরবনের পর এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় ব্রিহত্তম শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল ও দিনে দুইবার জোয়ার-ভাটায় প্লাবিত হয় ও লবণাক্ত ও মিষ্টি মাটির মিশ্রণের কারণে এখানে রয়েছে সারি সারি বিলুপ্ত প্রজাতির গাছ ও পশুপাখি।
টেংরাগিরি বন টি সবুজ ঘন ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, সৈকতের পাড়ে লাল কাকড়ার ছুটোছুটি ও শেষ বিকেলের সূর্য অস্তের দারুণ এক দৃশ্য যে কোন পর্যটকের মুগ্ধ করার মত। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভ্রমণপিপাসু পর্যটকরা এখানে ব্যস্ত শহরের যানজট এড়িয়ে নিরিবিলি কোলাহল ও সমুদ্রের বিশালতার মাঝে হারিয়ে যেতে আসে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ১৩ হাজার ৬৩৪ একর জমির ওপর তালতলী উপকূলীয় টেংরাগিরি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ২০১২-১৩ অর্থবছরে সকিনা বিটের আওতায় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়াতে ইকোট্যুরিজম পার্ক নির্মাণ করে। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করেন। ওই সময় ইকোট্যুরিজমে ৫টি কুমির, ৯টি হরিণ, ২৮টি শূকর ও ১টি মেছোবাঘ ছিল। খাবার সরবরাহে সংকটের কারণে ২০১৮ সালে সংরক্ষিত এলাকা থেকে শূকর, কচ্ছপ ও মেছোবাঘ বনে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এরপর হরিণের বেষ্টনী থেকে ৪টি হরিণও ছেড়ে দেয়া হয়। বর্তমানে ইকোপার্কের সংরক্ষিত বেষ্টনীতে ২টি কুমির ও ৩ টি হরিণ রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সদস্য, সাংবাদিক ও গবেষক শফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, তালতলী ট্যাংরাগিরি ইকোপার্কটি পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় জায়গা। ফরেস্ট বিভাগের পর্যাপ্ত লোকবল না থাকায় বর্তমানে অরক্ষিত। এটা আসলেই কাম্য নয়।
ইকোপার্কে নিরাপত্তা জোরদার করতে কি কি করনীয় এ বিষয়ে তিনি বলেন, ফরেস্ট বিভাগের চাহিদা অনুযায়ী লোকবল নিয়োগ দিলে যেমন বনটি সংরক্ষিত থাকবে তেমনি নারী ধর্ষণ, পর্যটকদের নিরাপত্তাহীনতা, বন উজাড়ের মতো কোনো ঘটনা ঘটবে না। ফরেস্ট বিভাগের পাশাপাশি পর্যটন উন্নয়ন কর্পোরেশনের বিশেষ তদারকির জন্য বিশেষ টিম রাখার সুপারিশ করেন তিনি।
সোনাকাটা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সুলতান ফরাজী জানান, ইকোপার্কে নিরাপত্তা জোরদার করতে জনবল ও রাস্তাঘাট সংস্কার সহ টেংরাগিরি বন থেকে সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত যেতে যে ছোট ছোট খাল গুলো আছে তার উপরে কালভার্ট নির্মাণ করলে দর্শনার্থীদের সুবিধা হত ও পাশাপাশি সরকারের অনেক রাজস্ব অায় বাড়াতো।
তালতলী বন কর্মকর্তা মোঃ মনিরুজ্জামান বলেন, আমরা সর্বদা চেষ্টা করি বনের মধ্যে পর্যটকদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য। তাছাড়া বনের মধ্যে যে সব অপরাধ সংঘটিত হয় সেসব বিষয়ে কে তিনি সামাজিক অসচেতনতা কে দায়ী মনে করছেন। তিনি অারো বলেন, রাজনৈতিক ও স্থানীয়দের সচেতনতায় টেংরাগিরি ইকো পার্কের মধ্যে অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব। বনের গাছ ও বনজ সম্পদ লুটের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুর্বত্তরা রাতের আধারে চুরি করে নিয়ে যায়।