বরগুনায় শুধু নয়ন বন্ডই নয়, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় একাধিক কিশোর গ্যাং গ্রুপের সন্ধান মিলেছে। এই গ্যাং গ্রুপ ও তাদের কর্মকান্ড নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ।
চাঞ্চল্যকর রিফাত হত্যার ঘটনায় সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার কারণে আলোচনায় আসে বরগুনার সংঘবদ্ধ কিশোর গ্যাং ০০৭ বন্ড গ্রুপ। এই গ্যাং গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা নয়ন বন্ড বন্দুকযুদ্ধে নিহত ও সেকেন্ড ইন কমান্ড রিফাত ফরাজী গ্রেপ্তার হওয়ার পরপরই গা ঢাকা দেয় গ্রুপের সক্রিয় সদস্যরা।
নয়ন বন্ডের ০০৭ সেভেন গ্রুপটি সক্রিয় থাকলেও ঘটনার পর অনেকেই গ্রুপ থেকে সটকে পড়েছে। বর্তমানে এই গ্রুপে ১১৯জন সদস্য রয়েছে। এসব সদস্যদের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, প্রায় প্রত্যেকেই বরগুনার মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের অধ্যয়নরত। বিশেষ করে বরগুনা জিলা স্কুল ও বেসরকারি প্রি-ক্যাডেট স্কুলের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের এক বিরাট অংশ এ গ্রুপে যুক্ত ছিল। শহরের উচ্চবিত্তের পাশাপাশি হতদরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থী কিশোরও এই গ্রুপে সম্পৃক্ত।
এছাড়াও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ, জনপ্রতিনিধি, গণমাধ্যমকর্মীদের স্বজন, পুলিশ অফিসার ও সরকারি কর্মকর্তাদের ছেলেরাও এসব গ্রুপের সদস্য ছিল। রিফাত শরীফ হত্যার পর তারা গ্রুপ ত্যাগ করে এবং নতুন করে ‘পার্ট অব ০০৭’ নামের একটি গ্রুপ তৈরি করে । কিন্ত এ গ্রুপটি নিমেষেই বিলুপ্ত হয়ে ফের টিম ৬১ নামের একটি গ্রুপ তৈরি করে।
০০৭ থেকে পার্ট অব ০০৭ অতঃপর টিম ৬১ গ্রুপ তৈরীর পর ওই কিশোরেরাই আবার রিফাত শরীফ হত্যার বিচারের দাবিতে শহরের মিছিল ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। গ্রুপ সদস্যদের প্রতি পুলিশের নজরদারির পর টিম ৬১ গ্রুপটিও বিলীন হয়ে যায়। পরবর্তিতে নতুন করে কোনো কিশোর গ্যাং গ্রুপের সন্ধান মেলেনি। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় বা গ্রুপভুক্ত না থাকলেও বড় ভাইদের সাথে কোনো না কোনোভাবে এরা যোগাযোগ রাখছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৭ সাল থেকে বরগুনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেভিত্তিক বেশ কয়েকটি গ্যাং গ্রুপ গড়ে ওঠে। এসব গ্রুপে তথ্য শেয়ারিংয়ে ব্যবহৃত হয় ম্যাসেঞ্জার অ্যাপ। ষষ্ঠ থেকে শুরু করে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে অধ্যয়নরত কিশোরদের একাংশ মূলত এই গ্রুপের সাথে যুক্ত হয়। গ্রুপের পরিচালনা ও সক্রিয় সদস্য হিসেবে কিশোরদের অনেকে যুক্ত থাকলেও মূলত তাদের নেতৃত্বে থাকেন নেপথ্যের ‘বড় ভাই’। স্বপ্নবাজ কিশোররা বিলাশবহুল জীবন যাপনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে রঙিন এক জগতে পদচারণা করে এসব গ্রুপে। আর বড় ভাইদের টার্গেট থাকে মূলত এদের ব্যবহার করে নিজেদের ফায়দা লোটার। মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে নানা ধরণের অসামাজিক কর্মকান্ডে ব্যবহৃত হয় এসব কিশোর। বিশেষ করে, ছোটখাট দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ফাইলবাজি, ইভটিজিং, মাদক বিক্রি ও নতুন করে মাদকে অভ্যস্ত করার কাজগুলো এরাই করে থাকে।
রিফাত হত্যার ঘটনার পর গ্যাং গ্রুপগুলো ফেসবুক থেকে বিলুপ্ত হলেও কার্যত তাদের সংঘবদ্ধ কর্মকান্ড এখনো অব্যহত রয়েছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। নয়ন বন্ড নিহত হওয়ার পর কিশোরদের একাংশ মূলত অন্তরালে চলে গেলেও অপর একটি অংশ একজন ছাত্রলীগ নেতার নেতৃত্বে এখনো সক্রিয় রয়েছে। কলেজে নয়ন বন্ডের সহযোগী হিসেবে এরা বন্ড গ্রুপে যুক্ত থাকলেও ছাত্রলীগ নেতার এই গ্রুপটি খারাকান্দা সড়ক, জিলা স্কুল ও, নাথপট্টি লেক, গার্লস স্কুল সড়ক, মাদ্রাসা সড়ক, লোহাপট্টি, উকিল পট্টি ও সার্কিট হাউজ মাঠ এবং এর আশাপাশ জুড়ে এদের বিচরণ। কিশোরদের মাদকে আসক্ত করা, মাদক বিক্রিসহ বিভিন্ন ফাইলবাজিতে যুক্ত এই গ্রুপ। রিফাত শরীফ হত্যাকান্ডের পর গোটা কলেজ ও আশপাশের এলাকা এখনো থমথমে। ঠিক এ অবস্থার মধ্যেও সপ্তাহখানেক আগে কলেজে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে এই গ্রুপ। পরে ওই নেতা নিজে তাদেরকে লোহাপট্টি আড্ডাস্থলে ডেকে মিমাংসা করেন।
জেলা ছাত্রলীগের আরেক নেতা গত কয়েক বছর ধরে আলাদাভাবে কিশোরদের একটি গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। এই গ্রুপের বিরুদ্ধে মাদকব্যবসাসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে বরগুনা জিলা স্কুলের ছাত্রদের মাদকে আসক্ত করে নিজের অনুসারি তৈরি করা, জেলা সদরের বিভিন্ন স্পটে নিজের অনুসারিদের দিয়ে মাদক ব্যবসা পরিচালনা করা, জমি দখলসহ নানা ধরণের কর্মকান্ডে এই গ্রুপটি যুক্ত।
এছাড়াও সদর উপজেলা তাঁতী লীগের এক নেতার নেতৃত্বেও একটি গ্রুপ রয়েছে।
বিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত বড় ভাই কালচারের মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রাথমিক গ্রুপিং। রিফাত হত্যার সাথে জড়িত নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজী, রিশান ফরাজীসহ বেশ কয়েকজনই বরগুনা জিলা স্কুলের ছাত্র ছিলেন। এছাড়াও জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার আরিয়ান শ্রাবন ০০৭ বন্ড গ্রুপটির (Admin) পরিচালকদের একজন। এছাড়া হত্যাকান্ডে সরাসরি অংশ নেয়া রাতুল সিকদারও একই বরগুনা জিলা স্কুলে নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত।
০০৭ সেভেন গ্রুপে রিফাত হত্যায় গ্রেপ্তার আরিয়ান শ্রাবন ও রাতুল সিকদারের সহপাঠি কয়েকজনের সাথে কথা হয়। ঘনিষ্ঠ সহপাঠি মেহেদি হাসান ইমন বলেন, ‘মূলত রাতুল সিকদার সাধারণ পরিবারের ছেলে, কিন্তু সবসময়ই তার চলাফেরা ছিল ধনাঢ্য পরিবারের ছেলেদের সাথে। এছাড়াও বড় ভাইদের সাথে চলাফেরা ও তাদের অনুসরণ করার প্রবণতা ছিল।’
আরিয়ান শ্রাবনের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু জানান, শ্রাবনের বাসা একদমই মূল শহরে। বাবার আদরের সন্তান হওয়ার সুবাদে খুব কম বয়সে তার হাতে মুঠোফোন চলে আসে। দীর্ঘবছর ধরে সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংযুক্ত। সন্ধ্যার পরে যেখানে মাদকের আড্ডা এমন একটি এলাকায় তার বাসা। অর্থাৎ, হাত বাড়ালেই মাদক মেলে এমন স্থানে থাকায় সে মাদকে আসক্ত হয়ে পরে। এ কারণেই শ্রাবনও ওই গ্রুপে যুক্ত হয়ে যায়। বিভিন্ন ‘হরর ফিল্ম’ দেখা ও সিরিজ কিলিং গেম খেলায় আসক্ত হয়ে পরে। পাশাপাশি ছোটো ছোট গ্রুপে আড্ডা দিয়ে মেয়েদের টিজিং, দামী বাইকে উচ্চশব্দে হর্ণ বাজিয়ে বেপরোয়া গতিতে পথচলা এই গ্যাং গ্রুপের এক ধরণের বৈশিষ্ট্য। এরা প্রত্যেকে গ্রুপ নিজস্ব সাংকেতিক বিশেষ চিহ্ন ব্যবহার করে। এক একটি গ্রুপের লিডারদের নেতৃত্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলবদ্ধ চলাফেরা করে এবং সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিদ্যালয়ের কেবিনেট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে কিশোররা। এই গ্রুপিংয়ে বাহুবল প্রদর্শন করতে হয়। আর তখনি বড় ভাইদের স্মরণাপন্ন হন কেবিনেট নির্বাচনে অংশ নেয়া কিশোরদের গ্রুপ লিডার। এখান থেকেই মূলত বড় ভাইদের সাথে যুক্ত হয়ে পরে এসব কিশোর। আর বড় ভাইয়েরাও সুযোগটা বুঝে নেন ঠিকঠাক। নিজেদের অনুসারি তৈরিতে সহায়তা করেন ওইসব কিশোরদের। এরা নিজেদের মধ্যে তুচ্ছ বিষয়াদি নিয়েও অনেক সময় বাক বিতন্ডা এমনকি মারামারিতে লিপ্ত হয়।
গত ১০ বছর ধরে বরগুনা জিলা স্কুলের সামনে বেচা-বিক্রিতে জড়িত একজন জানান, প্রায়ই এই স্কুলের ছাত্ররা মারামারি করে। পরে বড় ভাইয়েরা এসে মিমাংসা করে দেন। বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘বিদ্যালয়ের ছাত্রদের একাংশ, যারা নেতৃত্বে আসতে চায় তাদের প্রায় সবাই কোনো না কোনো বড় ভাইদের সাথে সম্পর্ক রাখে। বিভিন্ন প্রয়োজনে বড় ভাইয়েরা এগিয়ে আসেন।’
এদের কেউ মাদকের সাথে যুক্ত কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সবাই তো আর ভালো না, কেউ কেউ এর সাথে জড়িয়ে যায়’।
ওই বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী জানান, এই বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বড় ভাইদের সাথে কিছু শিক্ষার্থীর যোগাযোগ রয়েছে। এই বড় ভাইয়েরা তাদের অনেককেই মাদকে আসক্ত করে। তবে বড় ভাই কারা এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাননি তিনি।
শহরের প্রভাবশালী তরুণদের ছত্রচ্ছায়ায় মাদক ব্যবসায় যুক্ত একটি চক্র সু-কৌশলে এইসব কিশোরদের টার্গেট করে মাদক সেবনে অভ্যস্ত করে। মাদকে আসক্ত হওয়ার পর কেউ কেউ সরাসরি খুচরা বিক্রেতায়ও পরিণত হয়। রিফাত হত্যার পর বরগুনায় এসব কিশোরদের গ্রুপ লিডার হিসেবে রাজনীতির সাথে যুক্ত বেশ কয়েকজন তরুণের নাম গণমাধ্যমে চলে আসে। এসব তরুণদের অনেকেই গা ঢাকা দিলেও গ্রুপের সাথে তাদের যোগাযোগ রয়েছে বলে জানা যায়।
বরগুনার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন বলেন, ‘‘কিশোর গ্যাং গ্রুপ এর হোতাদের চিহ্নিতকরণ চলছে। ইতোমধ্যে আমরা বেশ কিছু তথ্য উপাত্ত হাতে পেয়েছি। এছাড়াও আমাদের পুলিশের বিভিন্ন উইং এ বিষয় নিয়ে কাজ করছে। নতুন করে গ্যাং গ্রুপ তৈরি হওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই এখানে।’’