স্পোর্টস ডেস্ক :
খেলাধুলায় অনেক ব্যস্ত বছর ছিল ২০২২ সাল। সাফ গেমসে বাংলার মেয়েদের ইতিহাস থেকে বিশ্বকাপ উন্মাদনা-কী ছিল না এই বছরে? তবে এত আনন্দের মাঝেও বছরের শেষটা হয়েছে বেদনার সুর বেজে। এই বছরই ফুটবলার রাজা খ্যাত কিংবদন্তি পেলেকে হারিয়েছে বিশ্ব।
এক নজরে ঘটনাবহুল বছরটি
১. ইতিহাস গড়ল বাংলার মেয়েরা
ফুটবলে বাংলাদেশের ছেলেরা বারবার হতাশ করলেও এবার ইতিহাস গড়ল বাংলাদেশের মেয়েরা। ২০২২ সালে নারী ফুটবলাররা দেশের জন্য বয়ে এনেছে অনন্য এক অর্জন। হিমালয়কন্যা নেপালের দশরথ স্টেডিয়ামে স্বাগতিক নেপালকেই হারিয়ে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। যা এনে দিয়েছে নারী ফুটবলের প্রথম বড় শিরোপা। অসাধারণ এক মাইলফলকের ইতিহাস লিখে দেশে ফেরার পর সাবিনা-শামসুন্নাহার-কৃষ্ণাদের ছাদখোলা বাসে বরণ করে নিয়েছিল দেশবাসী। সূর্যকন্যাদের হাত ধরে উন্মোচিত হয় নারী ফুটবলের নতুন দুয়ার।
২. মেসির অমরত্ব নিশ্চিত হলো
লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। সর্বকালের সেরার তর্কটা তিনি থামিয়েছেন, বলা ভালো থামিয়েছেন প্রবল বিক্রমে। একটা বিশ্বকাপ জিততে, জেতাতে সামর্থ্যের চেয়ে বেশি দিয়েছেন তিনি। বিশ্বকাপের সঙ্গে আরও অনেকগুলো রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন। বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ম্যাচ (২৬) খেলেছেন। আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোল (১২) তার। বিশ্বকাপ ইতিহাসে মেসিই প্রথম ফুটবলার- যিনি গ্রুপপর্ব, শেষ ষোলো, কোয়ার্টার ফাইনাল এবং ফাইনালে গোল করার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। একটা বিশ্বকাপে দেশকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে একজন নেতার যা যা করার প্রয়োজন, সব করেছেন মেসি।
৩. আর্জেন্টিনার বিশ্বজয়
সৌদি আরবের কাছে হার দিয়ে শুরু। অথচ তাদেরই ধরা হচ্ছিল বিশ্বকাপের সবচেয়ে ফেভারিট! হোঁচট না খেলে কেউ হাঁটতে শেখে কীভাবে? আর্জেন্টিনা দলটার অবস্থাও এমন হলো। সৌদি আরব যেন তাদের হাঁটতে শেখালো। একটি হারের পর আকাশী-নীলরা যেন আরও তাতিয়ে উঠল। লিওনেল স্কলোনির দক্ষ কোচিং, লিওনেল মেসির সর্বস্ব উজাড় করে দেওয়া আর মেসির জন্য বিশ্বকাপ জিততে চাওয়া ক্ষ্যাপাটে সতীর্থদের নিজেদের নিংড়ে দেওয়া। গোটা বিশ্ব দেখলো ৩৬ বছরের শিরোপাখরা কাটাতে একটি দেশ কতটা উন্মত্ত হতে পারে। রক্ষণ থেকে আক্রমণ, প্রতি বিভাগে ক্রমাগত উন্নতির সঙ্গে বিপক্ষের কৌশল বুঝে খেলার ধরন পাল্টানো এই আর্জেন্টিনাকে দেখে মনেই হয়েছে, এরা বিশ্বকাপ জিতে তবেই ফিরবে। ভুল হয়নি। মরুর বুকে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনার হাতেই উঠেছে এবারের বিশ্বকাপ।
৪. কাতার বিশ্বকাপ ছাড়িয়ে গেছে সবকিছু
কাতার বিশ্বকাপ নানান কারণেই ছিল আলোচনায়। কাতারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে ঝড় ওঠে বিতর্কের। মাঠে বিয়ারে চুমুক দেওয়া যাবে না, প্রকাশ্যে চুম্বন নিষিদ্ধ, সমকামিতার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা, নারীদের পোশাকে বাধ্যবাধকতা দেওয়া নিয়ে বেঁকে বসে অনেকেই। শেষ পর্যন্ত ফিফার হস্তক্ষেপে অনেকাংশেই নমনীয় হয় কাতার। তবে মাঠের বাইরের সেসব আলোচনা আড়ালে চলে যায় খেলা শুরুর পর। ফুটবলের মহাযজ্ঞ প্রথমবার বসেছিল মরুর বুকে। মরুর উত্তপ্ত বালিতে যেন ফুল ফোটালো দলগুলো। অঘটন ঘটন পটীয়সী আসর হিসেবে সবার মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে এই বিশ্বকাপ। সৌদির কাছে হার দিয়ে আর্জেন্টাইনদের শুরু, আবারও গ্রুপপর্ব থেকে জার্মানির বিদায়, মরক্কোর স্বপ্নীল যাত্রা, ব্রাজিলের হেক্সা মিশনে অপেক্ষা দীর্ঘায়িত হওয়া, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ভুলে যাওয়া আসর, এমবাপ্পের জাত চেনানো, প্রযুক্তির মারপ্যাঁচ আর ফাইনালের রোমাঞ্চ মিলিয়ে বাইশের বিশ্বকাপ হয়ে রইলো অনেকের দেখা সর্বকালের সেরা বিশ্বকাপ।
৫. বিদায় ফুটবলের মহারাজা পেলে
সাধারণ জ্ঞানের একটি প্রশ্ন আছে এমন, ফুটবলের রাজা কে? উত্তর সকলের জানা। তিনি ‘পেলে।’ এডসন অরান্তেস দো নসিমন্ত পেলে। সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ফুটবলার কেবল ব্রাজিলের ফুটবল নয়, বদলে দিয়েছিলেন বিশ্ব ফুটবলের চিত্রও। তিনি ছিলেন খেলাটিরও ঊর্ধ্বে। শুধু ফুটবল নয়, বিশ্ব ক্রীড়া দুনিয়ার এই মহাতারকা বছরের শেষাংশে এসে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। হাসপাতালে ভর্তি হন নভেম্বরের ২৯ তারিখ। অসংখ্য ডিফেন্ডারের ঘুম হারাম করা কিংবদন্তি পেলেকে সুস্থ করতে ঘুম হারাম হয়েছিল সাও পাওলোর আলবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালের চিকিৎসকদের। আগে থেকেই শরীরে বাসা বাঁধা ক্যানসারের পাশাপাশি কিডনি ও হার্টের সমস্যায় আর পেরে ওঠেননি ৮২ বছর বয়সী পেলে। মহারাজ চলে গেলেন ২৯ ডিসেম্বর। রেখে গেলেন নিজ হাতে গড়া সহস্র ইতিহাস।
৬. রিয়াল মাদ্রিদের চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়
উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ আর রিয়াল মাদ্রিদ বহুদিন ধরেই সমার্থক শব্দ হয়েছে। টানা তিনটি শিরোপা জয়ের ৪ বছর পর ফের ক্লাব ফুটবলের সেরার তকমা পায় স্প্যানিশ জায়ান্টরা। রেকর্ড ১৪তম শিরোপা জয়ের পথে ফাইনালে লিভারপুলকে ১-০ গোলে হারায় বেনজেমা, মদরিচরা। মাদ্রিদের শিরোপা জয়ে ১৫ গোল করে অবদান রাখেন করিম মোস্তফা বেনজেমা। মৌসুম জুড়ে ছিলেন অনবদ্য। নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়া বেনজেমা পেয়ে যান ক্যারিয়ারের প্রথম ব্যালন ডি’অরের দেখা।
৭. স্পেনের রাজা রিয়াল মাদ্রিদ, ইংল্যান্ডের ম্যানসিটি
স্প্যানিশ লা লিগায় রেকর্ড ৩৫তম শিরোপা জয়ের স্বাদ পায় রিয়াল মাদ্রিদ। ২০২২ সালে বেশ দাপটের সঙ্গে লিগ টাইটেল নিজেদের করে নেয় কার্লো আনচেলত্তির শিষ্যরা। লিগে চার ম্যাচ হাতে রেখেই শিরোপা বগলদাবা করে মাদ্রিদ। মৌসুমে বাকি দলগুলো থেকে স্পষ্ট ব্যবধানে এগিয়ে রাজত্ব করে লস ব্লাংকোসরা। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ম্যানচেস্টার সিটি লিগ টাইটেল ধরে রাখলেও শিরোপা জিততে অপেক্ষা করতে হয়েছে একদম শেষ ম্যাচ পর্যন্ত। পেপ গার্দিওলার অধীনে টানা দ্বিতীয় টাইটেল জিতেছে সিটি। সর্বশেষ এই কৃতিত্ব ছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের।
৮. রোনালদোর ভুলে যাওয়া বছর
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ক্যারিয়ারে যা কিছু অর্জন করেছেন, নিজের পরিশ্রম ও জেদের ফলেই। রোনালদো মানেই জয়ের তীব্র ক্ষুধা। একজন সিআরসেভেন দলে থাকা মানে বাড়তি আত্মবিশ্বাস। কিন্তু সেই রোনালদোই নিজেকে হারিয়ে খুঁজেছেন ২০২২ জুড়ে! ক্লাব, জাতীয় দল সবখানে হয়ে পড়েছেন ব্রাত্য। ৩৭ বছরের এই রোনালদো অচেনা সবার কাছে। প্রথমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের অনুশীলনে না আসা, খেলা শেষ না করেই মাঠ ছেড়ে চলে যাওয়া, এরপর বেঞ্চে বসা। বিশ্বকাপ শুরুর আগে বোমা ফাটালেন পুরো ইউনাইটেড ম্যানেজমেন্ট নিয়ে। বিশ্বকাপে হয়ে রইলেন নিজের ছায়া। পর্তুগালের মহানায়ক শেষাংশে যেন খলনায়কের ভূমিকায়। মরক্কোর কাছে হেরে পর্তুগালের যাত্রা থামে, কান্নাভেজা রোনালদোকে দেখে মন খারাপ বেড়ে যায় ভক্তদের।
৯. ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষস্থান ধরে রাখল ব্রাজিল
বছর শেষের প্রকাশিত ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টিনাকে পেছনে ফেলে শীর্ষস্থান ধরে রাখে ব্রাজিল। ২০২২ এর ফেব্রুয়ারিতে বেলজিয়ামকে হটিয়ে শীর্ষস্থান দখল করে ব্রাজিল। এরপর টানা দশ মাস শীর্ষেই আছে তারা। যদিও বিশ্বকাপ আশানুরূপ হয়নি এবারও, তবুও কোনো ভাটা পড়েনি এতে। শীর্ষে থেকেই তাই নতুন বছর শুরু করবে সেলেসাওর