সালমান শাহের সঙ্গে শাবনূরকে বিয়ে দিতে খুবই আগ্রহী ছিল তাদের দুই পরিবার বলে জানিয়েছেন সামিরা হক।
জবানবন্দিতে তিনি বলেন, শাবনূর আমাদের বাসায় প্রায়ই আসত। আমি তা পছন্দ করতাম না। ইমন (সালমান শাহ) একবার শাবনূরকে নিয়ে কক্সবাজারে শুটিংয়ে যায়। সেখানে হোটেল উপলের একটি রুমে ইমনকে আটকে রেখেছিল শাবনূর। কৌশলে বেরিয়ে এসে ইমন আমাকে বিষয়টি জানায়।
পুলিশের তদন্ত সংস্থা পিবিআইকে ১৬১ ধারা ও আদালতে ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দিতে তিনি বলেন, শাবনূরের মা ও আমার শাশুড়ি ইমনের সঙ্গে শাবনূরের বিয়ে দেয়ার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী ছিল।
সালমানের মৃত্যুর ঘটনায় সংশ্নিষ্ট অন্যদের দেয়া সাক্ষ্যে সামিরার দেয়া তথ্যের বেশিরভাগের সত্যতা পাওয়া যায় বলে জানান তদন্তে যুক্ত কর্মকর্তারা।
চিত্রনায়িকা শাবনূর বলেছেন, প্রয়াত সালমান শাহ ছিলেন শুধুই আমার নায়ক, সহশিল্পী এবং বন্ধু। এর বাইরে কোনো সম্পর্ক ছিল না। তারপরও যদি কেউ এ সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলে, সেটা শুনতে বিশ্রী লাগে।
পিআইবির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সালমানের আত্মহত্যার পেছনে পাঁচটি কারণের মধ্যে একটি হল- শাবনূরের সঙ্গে সালমান শাহর অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা।
এর প্রতিক্রিয়ায় অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে বাংলাদেশি গণমাধ্যমকে শাবনূর বলেন, আমাকে জড়িয়ে এমন কথা কেন বলা হচ্ছে, তা আমি জানি না। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
সালমানের সঙ্গে পরিচয়পর্বের বর্ণনায় সামিরা জানান, ১৯৯০ সালে চট্টগ্রামের একটি ফ্যাশন শো-তে সালমানের খালার মাধ্যমে তাদের পরিচয় হয়। এরপর সাত দিন সেখানেই থাকেন সালমান। তিনি প্রায়ই সামিরার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন। ল্যান্ডফোনে কল দিতেন। সামিরার ভাষ্যে বিষয়টি এমন- সে আমাকে বিয়ে করতে চায়। আমাকে ছাড়া বাঁচবে না। আমাকে না পেলে আত্মহত্যা করবে ইত্যাদি বলে রক্ত দিয়ে চিঠি লিখত।
১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমার সঙ্গে কথা বলা নিয়ে ইমনের মায়ের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। এরপর সে তার বাসায় ৯০টি ইনোকটিন ট্যাবলেট খেয়ে মরতে চেয়েছিল।… ১৯৯২ সালের নভেম্বর মাসে কেয়ামত থেকে কেয়ামত ছবির শুটিংয়ের সময় মায়ের সঙ্গে ইমনের কথা কাটাকাটি হয়।
ওই সময় সে স্যাভলন খেলে তাকে মেট্রোপলিটন হাসপাতালে নিয়ে ওয়াশ করানো হয়েছিল। ১৯৯২ সালের ২০ ডিসেম্বর ইমনের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়।
এদিকে আত্মহত্যাই করেছিলেন বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় নায়ক সালমান শাহ। পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে হত্যার যে অভিযোগ করা হয়েছিল, এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। দীর্ঘ তদন্তের পর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এমনটাই জানিয়েছে।
সোমবার বেলা সাড়ে ১১টায় রাজধানীর ধানমণ্ডিতে পিবিআই সদর দফতরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান সংস্থাটির প্রধান বনজ কুমার মজুমদার।
তিনি বলেন, চিত্রনায়িকা শাবনূরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে পারিবারিক কলহ আর স্ত্রী সামিরার কারণে মা নিলুফা চৌধুরী ওরফে নীলা চৌধুরীকে ছেড়ে দূরে থাকার মানসিক যন্ত্রণায় ভুগেই অভিমানী সালমান শাহ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন বলে তাদের মনে হয়েছে।
তবে পিবিআই’র তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘এই প্রতিবেদন মনগড়া ও ভিত্তিহীন। আমি এই রিপোর্ট মানি না মানব না।’
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তার মধ্যে ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইস্কাটন রোডে নিজের বাসা থেকে সালমান শাহর (চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার ইমন) লাশ উদ্ধার করা হয়।
তখন ঘটনাটিকে আত্মহত্যা ধরে সে সময় অপমৃত্যু মামলা হয়। তাতে আপত্তি জানায় সালমান শাহর পরিবার। ১৯৯৭ সালে সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদনে ঘটনাটিকে ‘আত্মহত্যা’ উল্লেখ করা হয়। এরপর ২০০৩ সালের ১৯ মে মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে পাঠানো হয়।
এর প্রায় ১২ বছর পর ২০১৪ সালের ৩ আগস্ট বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এতেও সালমান শাহর মৃত্যুকে ‘অপমৃত্যু’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ২০১৫ সালের ১৯ এপ্রিল মহানগর দায়রা জজ আদালতে আবার রিভিশন আবেদন করেন সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী।
২০১৬ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বিশেষ জজ-৬-এর বিচারক ইমরুল কায়েস তা মঞ্জুর করে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন।
পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, তদন্তের দায়িত্ব নেয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে সালমানের তখনকার স্ত্রী সামিরাসহ ৪৪ জনকে। তাদের মধ্যে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন ১০ জন। তদন্তের ভিত্তিতে মামলার ৬০০ পৃষ্ঠার ডকেট তৈরি করেছে পিবিআই। আজ আদালতে জমা দেয়া হবে এই তদন্ত প্রতিবেদন। আগের দুই দফা ময়নাতদন্তে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য নিয়ে, তদন্তকালে সবার সাক্ষ্য বিবেচনা করে পিবিআই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। তাকে হত্যার কোনো প্রমাণ তদন্তে পাওয়া যায়নি।
সালমান শাহর মৃত্যুর এক বছর পর ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই তার বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী অপমৃত্যুর মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত করার আবেদন জানান। এরপর অপমৃত্যু মামলার সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের বিষয়টি একসঙ্গে তদন্ত করতে আদালত সিআইডিকে নির্দেশ দেন।
১৯৯৭ সালের ৩ নভেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে সিআইডি জানায়, তারা আত্মহত্যার আলামতই পেয়েছে। সিআইডির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে কমরউদ্দিন রিভিশন মামলা করেন। ২০০৩ সালের ১৯ মে মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে পাঠান আদালত। এরপর প্রায় ১২ বছর মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে ছিল।
এর মধ্যে কমরউদ্দিন মারা গেলে মামলাটি চালিয়ে যান সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী। যিনি এখন যুক্তরাজ্যে রয়েছেন। ২০১৪ সালের ৩ আগস্ট ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের কাছে বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন মহানগর হাকিম ইমদাদুল হক।
তাতে অপমৃত্যুর কথাই উল্লেখ করা হয়। নীলা চৌধুরী বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনও প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর হাকিম জাহাঙ্গীর হোসেনের আদালতে ওই প্রতিবেদনের বিষয়ে ‘নারাজি আবেদন’ দাখিল করেন।
তখন হত্যাকাণ্ডের আসামি হিসেবে সালমানের স্ত্রী সামিরা, তার মা লতিফা হক লুসি, ব্যবসায়ী ও চলচ্চিত্র প্রযোজক আজিজ মোহাম্মদ ভাই, রুবি, রিজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ, সহকারী নৃত্যপরিচালক নজরুল শেখ, ডেভিড, আশরাফুল হক ডন, মোস্তাক ওয়াইদ, আবুল হোসেন খান ও গৃহকর্মী মনোয়ারা বেগমের নাম উল্লেখ করেন নীলা চৌধুরী।
আদালত নারাজি আবেদনটি মঞ্জুর করে র্যাবকে দিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেন। এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে আবেদন করলে তা বাতিল হয়। এরপর পিবিআইকে দেয়া হয় তদন্তভার।
পিবিআই এ মামলার তদন্ত করতে গিয়ে সালমান শাহর মা বর্তমান বাদী নিলুফা চৌধুরী ওরফে নীলা চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। সাক্ষী হিসেবে হুমায়ুন কবির, আবদুস সালাম, দেলোয়ার হোসেন শিকদার, আবদুল খালেক হাওলাদার, বাদল খন্দকার (চলচ্চিত্র পরিচালক), শাহ আলম কিরণ (চলচ্চিত্র পরিচালক), মুশফিকুর রহমান গুলজার (চলচ্চিত্র পরিচালক), এসএম আলোক সিকদার ও হারুন আর রশিদকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
এরই মধ্যে সালমান শাহর যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ‘বিউটিশিয়ান’ রাবেয়া সুলতানা রুবি ২০১৭ সালে ফেসবুকে এক ভিডিওতে বলেন, আত্মহত্যা নয়, হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন সালমান শাহ এবং তা করিয়েছিল তারই স্ত্রী সামিরা হকের পরিবার।
এ নিয়ে তুমুল আলোচনা শুরুর পর আবার নিজের ওই বক্তব্য অস্বীকার করেছিলেন এই নারী। তবে সালমান শাহর পরিবার হত্যার অভিযোগ নিয়ে বরাবরই অনঢ় ছিল।
প্রসঙ্গত, রুপালি পর্দার সালমান শাহর আনুষ্ঠানিক নাম শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন। সিলেটের জকিগঞ্জে নানাবাড়িতে ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তার জন্ম।
আদমজি ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ড. মালেকা সায়েন্স ইনস্টিটিউট থেকে গ্র্যাজুয়েশন করা ইমন ১৯৯২ সালে বিয়ে করেন বিউটি পার্লার ব্যবসায়ীর মেয়ে সামিরাকে। তখন তার বয়স ২২ বছর।
মঈনুল আহসান সাবেরের লেখা ধারাবাহিক নাটক ‘পাথর সময়’-এর একটি চরিত্র দিয়ে ইমনের অভিনয় ক্যারিয়ার শুরু। মাত্র সাড়ে পাঁচ বছরের চলচ্চিত্র-জীবনে ২৭টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করা সালমান শাহ ঢাকাই সিনেমার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন।
নব্বইয়ের দশকে যারা বয়সে ছিলেন কিশোর-তরুণ, তাদের অনেকের হৃদয়েই সালমান শাহ বাংলাদেশের ‘সেরা রোমান্টিক অভিনেতা’ হয়ে থাকবেন।